উমরার প্রথম কাজঃ ইহ্রাম বাঁধা (ফরজ)
ইহ্রাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হারাম করা। হাজী সাহেবগন হজ্ব অথবা উমরা অথবা উভয়টা পালনের উদ্দেশ্যে নিয়ত করে যখন তালবিয়া পাঠ করেন, তখন তাদের উপর কতিপয় হালাল ও জায়েয বস্তুও হারাম হয়ে যায়। এ কারনেই এ প্রক্রিয়াটিকে ইহ্রাম বলা হয়। নামাজ যেমন নিয়ত ও তাকবীরে তাহ্রীমার দ্বারা শুরু হয়, তেমনি ইহ্রামের দ্বারা হজ্ব ও উমরার কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। মনে রাখা আবশ্যক যে, মীকাত থেকে ইহ্রাম বাঁধা সুন্নাত। যদি কেউ তার পূর্বেই ইহ্রাম বাঁধে, তবে তার ইহ্রাম শুদ্ধ হবে যদিও তার একটি সুন্নত বাদ পড়ে গেল।
আমরা বাংলাদেশীরা যদি বিমানে সরাসরি মক্কায় যাবার নিয়ত করি, তবে ইয়েমেনের মীকাত অনুসরন করে আমাদেরকে ইয়ালামলাম থেকে ইহরাম বাঁধতে হবে। কিন্তু এ স্থানটি যেহেতু জেদ্দার একটু আগে এবং এখানে বিমান অপেক্ষা করার মত অবস্থা থাকে না এবং বিমানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও গোছলের ব্যাপক সুবিধা নেই। অনুরূপভাবে যারা বয়োবৃদ্ধ ও বিমানের নতুন যাত্রী তাদের জন্য বিমানে বসে ইহ্রামের পোশাক পরিধান ঝুঁকিপূর্ন। তাই আমাদেরকে ঢাকায় বিমানে ওঠার আগেই ইহ্রাম বেঁধে নিতে হবে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ঢাকায় বসে যে ইহ্রাম বাঁধা হয়েছে তা প্রকৃত ইহ্রাম নয়। প্রকৃত ইহ্রামের বাস্তব সূচনা অবশ্যই হবে বিমান ছাড়ার অন্ততঃ ৫ঘন্টা পরে ইয়ালামলাম পর্বতের কাছাকাছি আসার পর। সৌভাগ্যের বিষয় যে বিমান সাধারনতঃ ইয়ালামলামের কাছাকাছি এলেই বিমান কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের অবহিত করেন যে, “কিছুক্ষনের মধ্যেই বিমান ইয়ালামলাম মিকাত অতিক্রম করবে।“ তখনই বাংলাদেশী হজ্জযাত্রীদের কর্তব্য হলো প্রকৃত ইহ্রাম বাঁধা এবং লাব্বাইক বলে তালবিয়া পাঠ করা। আর যদি আমরা সরাসরি মক্কায় না গিয়ে মদিনা শরীফে আগে যাই, তবে আমাদেরকে মদিনায় গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের মত জুল-হুলায়ফা তথা আবওয়াবে আলী থেকে ইহ্রাম বাধতে হবে। তবে উত্তম হলো প্রথমে মক্কায় হজ্জ্ব শেষ করে পরে মদিনায় জিয়ারত করা।
পুরুষের জন্য সেলাইবিহীন ৫ হাত লম্বা একখানা সাদা রংয়ের কাপড় লুঙ্গির মত পরতে হবে এবং ৫ হাত লম্বা আরেকখানা সাদা কাপড় এমনভাবে পরতে হবে যাতে দুই কাঁধ ও পিঠ ঢেকে যায়। এভাবে পুরুষদের ইহরামের কাপড় পরা শেষ করতে হবে। অন্যদিকে মহিলাদের ইহ্রামের জন্য শরীয়ত কোন পোশাক নির্দিষ্ট করে দেয়নি। মহিলাদের ইহ্রামের জন্য স্বাভাবিক পোশাকই পরতে হবে। তবে পোশাক আট-সাট বা এমন মিহি যেন না হয় যাতে শরীর স্পষ্ট হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। তবে সবচেয়ে ভাল হয় এমন পোশাক পরা যা মানুষের দৃষ্টি কাড়বে না। আলেমগন এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, মহিলা তার কামিজ, ওড়না, সেলোয়ার, পা মোজাসহ ইহ্রাম করতে পারে। লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ইহ্রাম অবস্থায় মহিলারা নেকাব ও পরবে না, আবার হাত মোজাও পরবে না। কিন্তু যদি অপরিচিত পুরুষ (বেমাহরাম) মহিলাদের পাশ দিয়ে যায়, তবে মাথার ওড়না দিয়ে তারা মুখ ঢেকে রাখবে এবং মাথার পর্দার জন্য টুপি ব্যবহার করবে।
ইহ্রাম বাঁধার জন্য বিশেষ কোন নামাজ নেই। তবে কোন ফরজ বা নফল নামাজের পরে ইহ্রামটি হওয়া মুস্তাহাব। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাধারনতঃ ফরজ নামাজের পরে ইহ্রাম বাঁধতেন। তাই ফরজ নামাজের সময় হলে ইহ্রামের কাপড় পরার পর নামাজ আদায় করতে হবে। আর ফরজ সালাতের সময় না হলে ইহ্রামের কাপড় পরিধান করার পর মাকরূহ ওয়াক্ত (ফজরের ফরজ নামাজের পর থেকে সুর্যোদয় পর্যন্ত এবং আছরের নামাজের পর থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত) না হলে তাহিয়্যাতুল ওজুর দু’রাকাত সালাত পড়ে নিতে হবে।
প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সুরা কাফেরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সুরা এখলাস পড়ুন। তবে স্মরন রাখা অত্যন্ত জরুরী যে ইহ্রাম বাধার পূর্বে যাবতীয় ক্ষৌরকর্ম সম্পাদনের পর গোছল করে পাক-পবিত্র হয়ে অথবা গোছলে অপারগ হলে ভালভাবে ওজু করে (আতর-সুগন্ধি ব্যহার করলে ভাল) নিতে হবে।
এরপর সালাত শেষে সালাম ফেরানোর পর মাথার টুপি খুলে রাখতে হবে এবং ইহ্রাম বাঁধার জন্য এভাবে নিয়ত করুনঃ
لبيك عمرة (লাব্বাইকা উমরাতান) অর্থঃ হে আল্লাহ ! আমি ওমরার জন্য প্রস্তুত। নিয়তের সাথে সাথে নিম্মের দোয়া পড়ুনঃ
اللهم انى اريد العمرة قيسرها لي و تقبلها منى-
(“আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল উমরাতা ফাইয়াস্সিরহালি ওয়া তাকাব্বালহা মিন্নি”।)
অর্থঃ হে আল্লাহ, আমি উমরাহ পালন করার নিয়ত করছি। আপনি আমার এই উমরাকে আমার জন্য সহজ করে দিন এবং তা কবুল করে নিন। এরপর পুরা তালবিয়া পাঠ করুন। তালবিয়া যখনই পড়া হবে, কমপক্ষে তিনবার পড়া উচিত। তালবিয়া হলো নিম্নরূপঃ
لبيك-اللهم لبيك -لبيك لا شريك لك لبيك- إن الحمد- والنعمة- لك والملك- لا شريك لك.
)“লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক্, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক্, ইন্নাল্ হাম্দা, ওয়ান্-নি’মাতা, লাকা ওয়াল্ মুল্ক, লা শারীকা লাক।“(
অর্থ : (তোমার দরবারে ) আমি হাজির, হে আল্লাহ ! (তোমার দরবারে ) আমি হাজির - আমি হাজির, তোমার কোন শরীক নাই, (তোমার দরবারে ) আমি হাজির, নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই, আর সকল সাম্রাজ্রের মালিকও তুমি, তোমার কোন শরীক নাই।
মনে রাখতে হবে যে নিয়ত করা এবং তালবিয়া পাঠ করা ইহ্রামের ফরজ।
হানাফী মাজহাব অনুযায়ী ইহ্রাম বাঁধার সময় তালবিয়া পাঠ অথবা অন্য কোনো যিকর একবার পাঠ করা ফরজ এবং একাধিকবার সুন্নত। উমরার ক্ষেত্রে ইহ্রামের নিয়ত করার সময় থেকে তালবিয়ার এই দোয়া শুরু করতে হবে এবং অব্যহত থাকবে বায়তুল্লাহ শরীফে পৌছে তওয়াফ শুরুর আগ পর্যন্ত । তাই সবসময় তালবিয়া পাঠ করে যাওয়া উত্তম। বিশেষ করে গাড়ীতে উঠতে, গাড়ী থেকে নামতে, বিমানে উঠতে, বিমান থেকে নামতে, কোন উচু জায়গায় উঠতে ও নামতে, দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসার সময়, কারো কাছে বেড়াতে গেলে এবং প্রত্যেক নামাজের পরে পুরুষেরা সশব্দে তালবিয়া পাঠ করবেন। কিন্তু মহিলাদের জন্য উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়া নিষিদ্ধ। নিজের কানে শুনতে পান মহিলারা এমনভাবে আস্তে আস্তে পড়বেন। এটা অবশ্যই স্মরন রাখতে হবে যে বিমানে থাকা অবস্থায় সালাতের সময় হলে একাকীই সালাত আদায় করতে হবে। ওযু না থাকলে তায়াম্মুম করে নিতে হবে। কোন অবস্থাতেই সালাত কাযা করার অপেক্ষায় থাকা যাবে না।
এরপর বিমান থেকে নেমে হাজী সাহেবানরা তাদের পূর্বনির্ধারিত বাসস্থানে গিয়ে নিজের মাল-ছামান গুছিয়ে রেখে একটু বিশ্রাম নিয়ে ক্লান্তি দূর করে নিতে পারেন। তাছাড়া তাওয়াফের পূর্বে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হওয়া জরুরী। সম্ভব হলে গোছল করে নেয়া মুস্তাহাব। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এমনটি করতেন। তবে নাপাকী থেকে অবশ্যই পবিত্র হতে হবে। এভাবে পাক-পবিত্র হয়ে তালবিয়া পড়তে পড়তে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পবিত্র কাবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে।
পবিত্র কাবার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদুল হারামের উঁচু বিল্ডিং। এ বিল্ডিং এর যেকোন দরজা দিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করা যায়। তবে “বাবুস্ সালাম” দরজা দিয়ে ঢোকা উত্তম।
আপনি যখন মসজিদে হারামে প্রবেশ করবেন, তখন অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে মসজিদের দরজায় প্রথমে ডান পা রাখুন এবং আল্লাহ যেন আপনার জন্য তার রহমতের সকল দরজা খুলে দেন সে আকুতি নিয়ে মসজিদে প্রবেশের সময় নিচের দোয়াটি পড়ুন। দোয়াটি হল :
بسم الله-والصلاة والسلام علي رسول الله- اللهم اغفرلى ذنوبى -وافتح لى ابواب رحمتك.
)“বিসমিল্লাহি ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আ’লা রাসুলিল্লাহি ; আল্লাহুম্মাগফিরলি জুনুবিই, ওয়াফ্তাহলি আব্ওয়াবা রাহ্মাতিকা।“(
অর্থ : মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি ,দোয়া ও সালাম রাসুল (সাঃ) এর উপর । হে আল্লাহ আমার পাপসমুহ ক্ষমা কর, আর আমার জন্য তোমার রহমতের দরজা খুলে দাও।
মসজিদে হারামে প্রবেশ করে যখনই কাবা শরীফের উপর প্রথম দৃষ্টি পড়বে, তখনই তিনবার পড়ুন-‘আল্লাহু আকবর’। তারপর নিম্নের তাকবীরটি তিনবার পড়ুন , তাক্বিরটি হলো-:
الله اكبر - الله اكبر- لا اله الا الله - الله اكبر- الله اكبر- و لله الحمد -
(“আল্লাহু আক্বর, আল্লাহু আক্বর, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আক্বর, আল্লাহু আকবর, ওলিল্লাহিল্ হাম্দ।“)
অর্থ : আল্লাহ মহান , আল্লাহ মহান , আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নাই । আল্লাহ মহান , আল্লাহ মহান ,সমস্ত প্রশংসা তারই জন্য।
তারপর দুই হাত দোয়ার জন্য উঠান এবং দরুদ শরীফ পড়ে নিজের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে নিম্নের দোয়াটি করুন-
اللهم انى اسءلك رضاك - و الجنة - و اعوذ بك من سخطك و النار -
(“আল্লাহুম্মা ইন্নি আস্আলুকা রেদাকা ওয়াল জান্নাতা ও আউজুবিকা মিন্ সাখাতিকা ওয়ান্নার।“)
অর্থ : হে আল্লাহ ! আমি তোমার সন্তুষ্টি ও জান্নাত কামনা করি এবং তোমার রাগ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাই।
ইহা একটি দোয়া কবুলের বিশেষ সময়। দোয়া কবুলের এমন সুবর্ন সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়।
উমরার দ্বিতীয় কাজঃ তাওয়াফ করা (ফরজ)
কাবা শরীফের চারদিকে পাক-পবিত্র অবস্থায় শরীয়ত নির্দেশিত নিয়মে সাতবার ঘোরা বা চক্কর দেওয়াকে তাওয়াফ বলা হয়। তাই তাওয়াফের পূর্বে সবারই পাক-পবিত্র হওয়া জরুরী। কোন মহিলা হায়েয বা নিফাস অবস্থায় অথবা বিনা অজুতে তাওয়াফ করতে পারবেন না। পবিত্র হবার পর মহিলারা তাওয়াফ করবেন। এখন আপনি তাওয়াফ করার জন্য কাবাঘরের যে দিকে ‘হাজরে আসওয়াদ’ আছে সেদিকে চলুন এবং সম্ভব হলে ‘হাজরে আসওয়াদ’ এর কাছে পৌঁছে আপনি ইহ্রামের যে চাদর/কাপড় পরিধান করে আছেন, সেই চাদরের ডান অংশ ডান বগলের নিচে দিয়ে বাম কাঁধের উপর রেখে দিন। অর্থাৎ ডান কাঁধ খোলা থাকবে এবং বাম কাঁধ চাদরে ঢাকা থাকবে। এরূপ করাকে এজতেবা বলে।
কোন কোন পুস্তিকায় শুধুমাত্র প্রথম চক্করেই ইজতেবা করার কথা বলা হয়েছে। স্মরন রাখতে হবে যে, পূর্ণ তাওয়াফেই (সাত চক্করেই) ইজতেবা করতে হবে- অর্থাৎ চাদর/কাপড়কে এভাবেই রাখতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ শুধু উমরার তাওয়াফের জন্যই ইজতেবা করতে হয়। তাওয়াফের পর নামাজ ইজতেবা করা মাক্রুহ। তাই আগে বা পরে অন্য কোন সময় ইজতেবা করে রাখা যাবে না।
তৃতীয়তঃ ইজতেবা শুধু পুরুষের জন্য, মহিলারা ইজতেবা করবে না।
এখন ইজতেবা অবস্থায় আপনি কা’বা মুখ হয়ে এমনভাবে দাড়াবেন যেন ‘হাজরে আসওয়াদ’ আপনার ডানদিকে থাকে। পূর্বে ‘হাজরে আসওয়াদ’ বরাবর একটি খয়েরি রেখা ছিল। বর্তমানে তা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই ‘হাজরে আসওয়াদ’ সোজা মসজিদুল হারামের দেয়ালে থাকা সবুজ বাতি দেখে ‘হাজরে আসওয়াদ’ বরাবর এসেছেন কিনা তা নিশ্চিত করুন এবং এ পর্যন্ত যে তালবিয়া পড়ে এসেছেন তা বন্ধ করে দিন। তারপর এভাবে তাওয়াফের নিয়ত করুন :
اللهم انى اريد طواف بيتك الحرام سبعة اشواط- فيسره لى- و تقبله منى.
(আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদু তাও’য়াফা বাইতিকাল্ হারামে সাবআতি আশ্ওয়াতিন্ ফাইয়াস্সিরহুলি ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নি)
অর্থ : হে আল্লাহ ! নিশ্চয়ই আমি তোমার ঘর সাত বার তাওয়াফ করার ইচ্ছা পোষন করি । উহাকে আমার জন্য সহজ করে দাও এবং আমার পক্ষ থেকে ঐ কাজকে কবুল করে নাও।
তাওয়াফের নিয়ত করা ফরজ। তাই প্রথমে নিয়ত করে নিতে হবে। নিয়ত মুখে উচ্চারন না করে মনে মনে করলেও চলবে। তারপর ডানদিকে একটু চলুন যেন ‘হাজরে আসওয়াদ’ ঠিক আপনার সম্মুখ বরাবর হয়ে যায়। তারপর নামাজের তাক্বীর তাহ্রীমার মত দুই হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে বলুন-
بسم الله الله اكبر- لا اله الا الله- و لله الحمد- والصلاة و السلام علي رسول الله.
(বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর,লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওলিল্লাহিল্ হামদ্, ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলা’ রাসুলিল্লাহি)
অর্থ : মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি , তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নাই । সমস্ত প্রশংসা তারই জন্য। সালাত ও সালাম রাসুল (সাঃ) এর উপর।
এবং হাত নামিয়ে সম্ভব হলে (ভিড় না থাকলে) ‘হাজরে আসওয়াদের’ উপর হাত দু’টো এমনভাবে রাখুন যেমনভাবে সিজদার সময় রাখা হয়। এরপর আদবের সংগে ‘হাজরে আসওয়াদ’ চুম্বন করুন। চুম্বন করা দুষ্কর হলে, ডান হাত দিয়ে ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্পর্শ করুন এবং হাতের যে অংশ দিয়ে স্পর্শ করেছেন সে অংশে চুম্বন করুন।
কিন্তু বর্তমানে বাস্তব অবস্থা এমনই যে, ‘হাজরে আসওয়াদ’ চুম্বন বা স্পর্শ বা উভয়টাই অত্যন্ত কঠিন ও অনেকের পক্ষেই দুঃসাধ্য। মনে রাখতে হবে যে, ‘হাজরে আসওয়াদ’ কে চুম্বন করা মোস্তাহাব। তাই চুম্বন করার জন্য অন্য ভাইকে কষ্ট দেয়া বা নিজে স্বেচ্ছায় কষ্ট পাওয়া হারাম। তাই দুরে দাঁড়িয়ে ডান হাত উঁচু করে হাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করুন (যেহেতু এ ক্ষেত্রে হাত দিয়ে ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি, তাই হাতে চুম্বন করতেও হবে না। তবে কোন কোন পুস্তকে চুম্বনের কথা বলা হয়েছে) এবং কাবা শরীফকে আপনার বাম দিকে রেখে তাওয়াফ আরম্ভ করুন ও বায়তুল্লাহর দরজার দিকে চলুন। প্রথম তিন চক্করে পুরুষ হাজীরা রমল করবেন অর্থাৎ বীরের ন্যায় বুক ফুলিয়ে কাঁধ দুলিয়ে, ঘন ঘন কদম ফেলে, কিছুটা দ্রুত গতিতে চলুন। এটা সুন্নত। বাকী চার চক্করে চলার গতি স্বাভাবিক রাখুন। তওয়াফের সময় দৃষ্টি সংযত করে নীচের দিকে রাখুন এবং অত্যন্ত আদবের সাথে তাওয়াফ করুন। কিন্তু মহিলা হাজীরা কোন রমল করবেন না।
কিছু কিছু পুস্তিকায় প্রত্যেক তওয়াফে ভিন্ন ভিন্ন দোয়া পড়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে হাদীসে কিছু পাওয়া যায় না। যখন যে ধরনের আবেগ আসে, সে ধরনের দোয়া করুন। আল্লাহর প্রশংসা করুন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর দরুন পড়ুন। যে ভাষা আপনি ভাল বোঝেন ও আপনার মনের আকুতি সুন্দরভাবে প্রকাশ পায় সে ভাষাতেই দোয়া করুন। স্মরন রাখতে হবে যে এখানে দোয়া কবুলের সু-সংবাদ রয়েছে।
তারপর সামনে অগ্রসর হলে দেখতে পাবেন অর্ধবৃত্তাকারে মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর ঘেরা একটি স্থান। একে ‘হাতীম’ বলে তারপর আরো কিছুটা অগ্রসর হলে আপনি পৌছে যাবেন কাবা ঘরের পশ্চিম-দক্ষিন কোনে যাকে ‘রুক্নে ইয়ামানী’ বলে। যখন ‘রুক্নে ইয়ামানী’ কোনে পৌছাবেন, তখন সেই কোনে চুমু খাবেন না, কান পর্যন্ত হাত উঠাবেন না। সম্ভব হলে দুই হাতে কিংবা ডান হাতে শুধু স্পর্শ করতে পারেন। হাতে স্পর্শ করতে না পারলে দুর থেকে ইশারাও করবেন না।
‘রুক্নে ইয়ামানী’ থেকে ‘হাজরে আসওয়াদ’ পর্যন্ত যেতে যেতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিম্নের দোয়া পড়তেন-
ربنا اتنا فى الدنيا حسنة و فى الاخرة حسنة وقنا عذاب النار-
(রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনইয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাত, হাসানাতাও ওয়াকিনা আয়াবান্নার)।
অর্থ : হে আমাদের রব দুনিয়া ও আখেরাতে আমাদের মংগল প্রদান কর এবং জাহান্নামের আজাব থেকে বাচাও।
এই দোয়া পড়তে পড়তে ‘হাজরে আসওয়াদ’ বরাবর পৌছালে এক চক্কর পূর্ন হয়ে যাবে। এখন(বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার) বলে সম্ভব হলে পুনরায় ‘হাজরে আসওয়াদ’ এ চুমু খাবেন। অথবা হাতের দুই তালু দিয়ে ইশারা করে আবার পূর্বের নিয়মে তওয়াফ শুরু করুন। এমনিভাবে সাত চক্কর পুরা করে তাওয়াফ কার্য শেষ করে দিন এবং চাদরের ‘ইজতবা’ খুলে ডান কাঁধ ঢেকে দিন।
স্মরন রাখতে হবে যে তাওয়াফ করা অবস্থায় কা’বা শরীফের দিকে দৃষ্টি করবেন না এবং নিজের বুক ও পিঠ কাবা শরীফের দিক করবেন না। তবে ‘হাজরে আসওয়াদ’ -এ চুমু দেয়ার সময় বুক কাবা শরীফের দিকে করা যাবে।
তওয়াফের সাত চক্কর, পূর্ন করে সম্ভব হলে ‘মুলতাযামে’ আসুন। ‘হাজরে আসওয়াদ’ এবং কা’বা ঘরের দরজার মধ্যবর্তী স্থানকে ‘মুলতাযাম’ বলে। ‘মুলতাযাম’ ধরে খুব দোয়া করুন। কিন্তু যদি এখানে খোশবু লাগানো থাকে, (যেমন- সবসময় লেগে থাকে) অথবা যদি এখন এখানে প্রচন্ড ভিড় থাকে, তবে এখন নয়। অন্য এক সময়ে সুযোগ-সুবিধা মত ‘মুলতাযাম’ কে আঁকড়ে প্রানভরে দোয়া করে নেবেন। এটা দোয়া কবুলের খাস জায়গা।
তাওয়াফ শেষ করার পর ‘মাকামে ইব্রাহীম’ কে সামনে নিয়ে অর্থাৎ ‘মাকামে ইব্রাহীম’এর পিছনে দুই রাকাত ‘সালাতুত তাওয়াফ’ এর নিয়তে দুই কাঁধ ঢেকে আদায় করুন। ভিড়ের কারনে এখানে সম্ভব না হলে তবে এর আশে পাশে কোথাও পড়ে নিন। তাও না পারলে ‘মসজিদুল হারাম’ এর যে কোন স্থানে এই নামাজ আদায় করে দোয়া করে নিন। প্রথম রাকাতে সুরা ফাতেহার পরে সুরা কাফেরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ফাতেহার পর সুরা এখলাস দ্বারা এই নামাজ আদায় করা উত্তম। নবীজি এভাবে পড়তেন। হানাফী মাজহাবে এই নামাজ ওয়াজিব।
মনে রাখতে হবে যে, ‘মাকামে ইব্রাহীম’ দোয়া কবুলের অন্যতম বিশেষ স্থান।
তাওয়াফের ওয়াজিব নামাজ পড়ার পর ‘যমযম’ কুপের কাছে আসুন এবং যমযমের এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে কেবলামুখী হয়ে দাড়িয়ে নীচের দোয়াটি পড়ুন-
اللهم انى اسئلك علما نافعا- و رزقا واسعا- و شفاء من كل داء.
(আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিয়ান - ওয়া রিজকান ওয়াসিয়ান - ওয়া শিফায়ান মিন কুল্লি দায়ীন।)
অর্থ : হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে ফলপ্রসু ইলম, স্বচ্ছল রিজিক এবং সকল রোগের নিরাময় কামনা করছি।
এবং তিন শ্বাসে ‘আবে যমযমের’ পানি পান করুন। যমযমের পানি তৃপ্তি সহকারে পেট ভরে পান করুন এবং কিছুটা পানি নিজের মুখমন্ডলে ও বুকে ছিটিয়ে দিন। তারপর কেবলামুখী হয়ে দোয়া করুন। এখানেও দোয়া কবুলের সু-সংবাদ রয়েছে।
যার শরীর পবিত্র আছে তিনি বরকতের জন্য যমযমের পানি দ্বারা ওজু অথবা গোসল করতে পারেন। এভাবে যমযমের পানি দ্বারা ওজু করা জায়েজ। তবে যমযমের পানি দ্বারা এস্তেঞ্জা এবং কাপড়ের নাপাকী দুর করার জন্য ব্যবহার করা অনুচিত।
হজ্জ্ব ও উম্রাহ
উম্রার তৃতীয় কাজঃ সা’ঈ করা (ওয়াজিব)
তাওয়াফ শেষে যমযম পানি পান করার পর ‘হাজরে আসওয়াদ’ এ সম্ভব হলে চুমু দিয়ে বা হাতে স্পর্শ করে সায়ীর উদ্দেশ্যে মনে মনে নিয়ত বা প্রতিজ্ঞা করুন যে, “হে আল্লাহ, আমি আপনার সন্তুষ্টির জন্য সাফা ও মারওয়ার সাঈ করার নিয়ত করছি। ইহা আমার জন্য সহজ করে দিন এবং কবুল করুন” এবং সাফা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হোন। চুম্বন বা স্পর্শ সম্ভব না হলে এক্ষেত্রে ‘হাজরে আসওয়াদ’ এর দিকে ইশারা করার কোন বিধান নেই।
সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অনুসরনে বলুন
ان الصفا و المروة من شعاءر الله – ابدء بما بدء الله به-
(ইন্নাস্ সাফা ওয়াল মার্ওয়াতা মিন্ শা’আ’ইরিল্লাহি, আব্দায়ু বিমা বাদাআল্লাহু বিহি)।
অর্থ : নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন সমুহের মধ্যে অন্যতম। আমি শুরু করছি আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন।
এই দোয়াটি এখানে ছাড়া আর কোথাও পড়বেন না। সা’ঈর প্রথম চক্রের শুরুতেই শুধুমাত্র পড়বেন। প্রতিচক্রে বারবার এটা পুনরাবৃত্তি করবেন না।
এরপর যতটুকু সম্ভব সাফা পাহাড়ের উপরে এতটুকু উঠুন যেন কাবা শরীফ নজরে পড়ে।(এখন আর পাহাড় নেই; মেঝেতে মার্বেল পাথর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।) তারপর কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দুই হাত পর্যন্ত তুলে তিনবার তাকবির বলে (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার) নিচের দোয়াটি তিনবার পড়ুন-
لا إله إلا الله - الله اكبر- لا إله إلا الله - وحده - لا شريك له- له الملك- وله الحمد – يحيى و يميت - وهوا على كل شيء قدير.
(লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ , আল্লাহু আকবার। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াহ্দাহু, লা-শারী’কালাহু। লাহুল্ মুল্ক, ওয়া লাহুল্ হাম্দ। ইউহ্’ঈ ও ইউ-মিতু, ও হুয়া আ-লা কুল্লে শাইয়েন কাদির।)
অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নাই । আল্লাহ মহান । তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নাই। তিনি এক ও একক। তার কোন শরীক নাই। সার্বেভৌমত্বের তিনিই মালিক। সমস্ত প্রশংসা তারই জন্য। তিনি জীবন ও মৃত্যু দিয়ে থাকেন এবং তিনি সর্বময় ক্ষমতার মালিক।
মনে রাখবেন, এই গুরুত্বপূর্ন দোয়াটি পরবর্তীতে মিনা, আরাফা এবং মুজদালিফায় বহুবার পড়তে হবে।
এই দোয়াটি পড়ার পর যত পারেন দুনিয়া ও আখেরাতের অসংখ্য কল্যান চাইতে থাকুন। আরবী ভালভাবে না বুঝলে নিজের ভাষায় আল্লাহর প্রশংসা করুন ও আপনার বৈধ ইচ্ছাগুলো তার দরবারে পেশ করুন। দোয়া শেষ হলে ‘সাফা’ থেকে নেমে ‘মারওয়ার’ দিকে হাটতে থাকুন। আর আল্লাহর যিক্র ও দোয়া করতে থাকুন। নিজের জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য এবং মুসলিম মিল্লাতের সবার জন্য। সাফা থেকে নেমে কিছু দূর এগুলেই উপরে ও ডানে-বামে সবুজ বাতি জ্বালানো দেখবেন। এই সবুজ বাতি জ্বালানোর প্রথম জায়গা/আলামত থেকে পরবর্তী সবুজ বাতি পর্যন্ত পুরুষ হাজীগন দৌঁড়ানোর মত করে দ্রুত গতিতে হেঁটে চলুন (এটা সেই জায়গা যেখানে হযরত হাজেরা (রাঃ) পানির জন্য দৌড়েছিলেন) এবং শেষ সবুজ বাতির আলামতের পরে চলার গতি আবার স্বাভাবিক করুন। তবে নারীদের ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় চলার গতি স্বাভাবিক থাকবে।
সবুজ দুই আলামতের মাঝে চলার সময় নিচের দোয়াটি পড়ুন-
رب اغفر – وارحم - و انت الاعذ الاكرام.
(রাব্বিগ্ফির ওয়ার্হাম ওয়া-আন্তাল্ আ-আজ্জুল্ আক্রাম)
অর্থ : হে আমার রব ! আমাকে ক্ষমা করে দাও ! তুমিতো মহা সম্মানের অধিকরী।
এভাবে হেঁটে মারওয়া পাহাড়ে পৌছে এর উঁচুতে আরোহন করুন। অতঃপর পবিত্র কাবার দিকে মুখ করে ‘সাফা’ পাহাড়ে যা যা পড়েছিলেন ও করেছিলেন সেগুলো এখানেও একই কায়দায় হাত তুলে তিনবার করুন। অর্থাৎ তিনবার ‘আল্লাহ আকবার’ তাকবীর বলে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ও আল্লাহু আকবর” থেকে “ও হুয়া আ-লা কুল্লে শাইয়েন কাদির’- পর্যন্ত পুরাটা তিনবার পড়ুন, অতঃপর দোয়া করুন। ‘সাফা’ থেকে ‘মারওয়া’ য় আসার পর আপনার একচক্র শেষ হলো।
এবার আপনি ‘মারওয়া’ থেকে নেমে আবার ‘সাফার’ দিকে চলতে থাকুন। সবুজ চিহ্নিত দুই বাতির আলামতের মধ্যবর্তী স্থানে পুরুষ হাজীরা আগের মত দৌড়ানোর মত করে দ্রুত গতিতে হেটে চলুন এবং সবুজ বাতির শেষে চলার গতি আবার স্বাভাবিক করুন। ‘সাফা’ পাহাড়ে পৌছে প্রথমবার যা যা পড়েছিলেন ও করেছিলেন এবার ও তা পড়ুন ও করুন। এভাবে প্রত্যেক চক্রেই এ নিয়ম পালন করে যান। ‘সাফা’ থেকে ‘মারওয়া’ গেলে হয় এক চক্র। আবার ‘মারওয়া’ থেকে ‘সাফায়’ ফিরে এলে হয় আরেক চক্র। এভাবে ৭(সাত) চক্র পূর্ণ করুন।
‘সাফা’ থেকে ‘মারওয়া’-র দূরত্ব প্রায় ৪৫০ মিটার - অর্থাৎ ৭(সাত) চক্কর দিলে (একবার সা’ঈ করলে) তিন কিলোমিটারের একটু বেশী পথ অতিক্রম করা হবে।
‘সাফা’ ও ‘মারওয়া’ -উভয়টা দোয়া কবুলের জায়গা। কাজেই ‘সাঈ’-র পথ বেশী মনে করে তাড়াতাড়ি ‘সাঈ’ সেরে নিয়ে বাসায় চলে যাবার চিন্তা করবেন না। ধীরে-সুস্থে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যেখানে যা করেছিলেন, সেখানে সেটা সেভাবেই করার চেষ্টা করুন। কতটুকু করলে ফরজ আদায় হয়ে যাবে এই চিন্তা মাথায় আনবেন না। বরং এটা টার্গেট বানাবেন যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কোথায় কোন কাজ কিভাবে ও কত সময় করেছন, আমি ও ঠিক সেভাবেই করব।
‘সাঈ’ করার সময় সালাত দাঁড়িয়ে গেলে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করুন। ‘সাঈ’ করার সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসে আরাম করে নিন। এতে ‘সাঈ’ করার কোন ক্ষতি হবে না।
‘তাওয়াফ’ করার সাথে সাথেই ‘সাঈ’ জরুরী নয়। তবে ‘তাওয়াফ’ করার সাথে সাথেই ‘সাঈ’ করা সুন্নত। যদি কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়ে বা অন্য কোন শারীরিক অসুবিধার কারনে কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে যায় তা বৈধ।
‘সাঈ’ পায়ে হেঁটে করা ‘ওয়াজিব’। যদি কোন অসুবিধা থাকে তাহলে ট্রলিযোগে ‘সাঈ’ করা যাবে।
উম্রার চতুর্থ কাজঃ হলক (ওয়াজিব)
‘সা’ঈর’ কাজ শেষ করার পর এখন আপনার আমল হচ্ছে ‘হলক’ করা। যার অর্থ সম্পূর্ন মাথা মুন্ডানো বা ছাঁটা। কমপক্ষে পুরুষ হাজীদের মাথার সমস্ত চুলের এক-চুতর্থাংশ ছেঁটে ফেলে দিতেই হবে। সাবধানতার জন্য একটু বেশী ছাঁটুন। সেলুনে গিয়ে চুল কামিয়ে বা মেশিন দিয়ে ছেঁটে নেয়া সুবিধাজনক। মারওয়া পাহাড়ের কাছেই চুল কাটার অনেক সেলুন রয়েছে।
মনে রাখা জরুরী যে চুল ছোট করে কাঁটার চেয়ে মাথা মুন্ডন করার মধ্যে সাওয়াব বেশী। কেননা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মাথা মুন্ডনকারীদের জন্য তিনবার রহমত ও মাগফিরাতের দোয়া করেছেন। অন্যদিকে যারা চুল খাট করে কেঁটেছেন, তাদের জন্য মাত্র একবার উক্ত দোয়া করেছেন।
মহিলাদের জন্য মাথা মুন্ডনের কোন বিধান নেই। তারা ‘সা’ঈ’ শেষে আপন আপন বাসস্থানে গিয়ে মাথার সব চুলের অগ্রভাগ থেকে আঙ্গুলের এক কড়া পরিমান (অর্থাৎ এক ইঞ্চির একটু কম পরিমান) চুল কেটে ফেলুন। স্মরন রাখতে হবে যে, মহিলারা এর চেয়ে বেশী পরিমান চুল কাটবে না এবং চুল নিজে কেঁটে ফেলুন বা কোন মহিলা দ্বারা বা মাহ্রাম ব্যক্তির দ্বারা কেঁটে নিন। কোন বেগানা পুরুষকে দিয়ে কাটানো হারাম।
এখন আপনি উম্রার ইহ্রাম থেকে হালাল হয়ে গেলেন। কাজেই ইহ্রামের পোশাক খুলে স্বাভাবিক পোশাক পরে নিন। এরপর হজ্বের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকুন।
তবে এখানে বিশেষভাবে স্মরন রাখার মত, মুল হজ্ঝ শুরুর আগে অর্থ্যাৎ আট জিলহজ্জের আগে এবং ওমরা পালন শেষে সাথে সাথে সম্ভব হলে কমপক্ষে একটি নফল তাওয়াফের সংগে একটি সাঈ করে নেওয়া উত্তম।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস থেকে বর্নিত- তিনি বলেন নবী করিম (সাঃ) এরশাদ করেছেন- আল্লাহ্তায়ালা প্রত্যেক দিন ও রাত মসজিদে হারামের প্রতি ১২০টি রহমত বর্ষন করে থাকেন। তন্মধ্যে এই ঘরের তাওয়াফকারীগনের প্রতি ৬০টি, এতে নামাজ আদায়কারীগন মুসল্লীদের প্রতি ৪০টি এবং এই ঘরের প্রতি দৃষ্টিদানকারীগনের প্রতি ২০টি রহমত দান করেন। সুতরাং মক্কাশরীফে অবস্থানকালে অধিক পরিমানে তাওয়াফ করতে থাকুন, কেননা এই তাওয়াফ দুনিয়ার আর কোথাও নাই।
হজ্জ পালনে কাজের ধারাবাহিকতাঃ দিনওয়ারী হজ্জের করনীয় কাজ
বাংলাদেশের মানুষ সাধারনতঃ ‘তামাত্তো হজ্জ’ করে থাকেন। হজ্জের মাসসমূহে (শাওয়াল, যিলক্বদ ও জিলহজ্জ) উম্রার ইহ্রাম বেঁধে প্রথমে উম্রা পালন করে ইহ্রাম খুলে ফেলা; অতঃপর হজ্জের জন্য পুনরায় ইহ্রাম বেঁধে হজ্জ সম্পন্ন করাকে ‘তামাত্তো হজ্জ’ বলে।
৮ জিলহজ্জ থেকে ১২ জিলহজ্জ পর্যন্ত এই পাঁচ দিনকে ‘আইয়ামে হজ্জ’ বা হজ্জের দিন বলা হয়। এই দিনগুলোতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ন রোকন- হজ্জ পালন করা হয়। ৮ তারিখ সকালে হাজী সাহেবানরা ৪/৫ দিনের উপযোগী ‘প্রবাস সরঞ্জাম’ নিয়ে মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য প্রস্তুত থাকেন। মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব ৪/৫ কিলোমিটার।
৮ জিলহজ্জঃ তারওয়ীয়াহ্র দিন
হজ্জের প্রথম দিন
আজ থেকে হজ্জের পাঁচদিন আরম্ভ হল। আপনি বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে একজন ‘তামাত্তো হজ্জ’ পালনকারী। তাই ওমরাহ্র সময় যেভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ইহ্রাম বেঁধেছিলেন, আপনার হোটেল বা বাসা থেকেই সেভাবে ইহ্রাম বাঁধুন। (তবে কুরবানীকারীরা ১লা জিলহজ্জ থেকে কোরবানীর পূর্ব পর্যন্ত চুল-নখ কাটবেন না।) ইহ্রাম বাঁধার সময় এভাবে নিয়ত করুন- لبيك حجا (লাব্বাইকা হাজ্জ্বান) অর্থঃ হে আল্লাহ আমি হজ্জ্বের জন্য প্রস্তুত) নিয়তের সাথে সাথে নিম্মের দোয়া পড়ুনঃ
اللهم انى اريد الحج قيسره لي و تقبله منى-
(“আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল হাজ্জা ফাইয়াস্সিরহুলি ওয়া তাকাব্বাল্হু মিন্নি”।)
অর্থঃ হে আল্লাহ, আমি হজ্জ পালন করার নিয়ত করছি। আপনি আমার এই হজ্জ আমার জন্য সহজ করে দিন এবং তা কবুল করে নিন।
দোয়া শেষ হওয়ার সাথে সাথে তিনবার তালবিয়া অর্থাৎ “লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, .................. “ একটু উচ্চস্বরে পড়ুন। (মহিলারা নীরবে পড়ুন)।
মনে রাখবেন যে হজ্জের জন্য ইহ্রাম বাঁধা ফরজ। তাই ইহ্রামের নিয়তের সাথে সাথে অবশ্যই তালবিয়া পাঠ করবেন। অন্যথায় ইহ্রাম শুদ্ধ হবে না এবং ইহ্রাম শুদ্ধ না হলে হজ্জ সহীহ্ হবে না।
এভাবে হজ্জের ইহ্রাম বাঁধা হয়ে গেল। সর্বদা তালবিয়া পাঠ করতে থাকুন এবং মোয়াল্লেমের গাড়ীর অপেক্ষায় থাকুন। সতর্ক থাকুন, যেন কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ না হয়। অনর্থক কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকুন। তারপর গাড়ী আসলে তালবিয়া পড়ে পড়ে মিনার দিকে রওয়ানা হন।
সূর্যোদয়ের পর মিনার দিকে রওয়ানা হওয়া সুন্নত। তাই চেষ্টা করুন, এ সুন্নতটি যেন ছুটে না যায়। তবে যদি মুয়াল্লেমের গাড়ী আগেই চলে আসে, তবে সূর্যোদয়ের আগেই চলে যান। এতে কোন সমস্যা হবে না। তবে এ দিন জোহরের আগেই মিনায় পৌঁছে জোহরের নামাজ পড়বেন। অতঃপর আসর, মাগ্রিব ও এশা এবং ৯ জিলহজ্জ ফরজ নামাজ আদায় করবেন। আপনি মুসাফির না মুকিম সে কথা বিবেচনায় রেখে চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজ দু’রাকাত করে কসর অথবা পুর্নাংগ আকারে পড়ুন। ৮ জিলহজ্জের আগে যদি আপনি মক্কা শরীফে মুকীম হিসাবে কমপক্ষে ১৫ দিন অবস্থান করে থাকেন, তবে মিনা, আরাফা ও মুজদালিফায় পুরো নামাজ পড়বেন। আর তা না হলে এসব স্থানে কসর পড়বেন। প্রতি বছরই এই মাসয়ালা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়।
৮ জিলহজ্জ দুপুর থেকে ৯ জিলহজ্জ ফজর বাদ সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। এ সময়ে বেশী বেশী কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার এবং মুসলিম উম্মার জন্য আল্লাহ্র কাছে রহমত কামনা করুন।
৯ জিলহজ্জঃ উকুফে আরাফা
হজ্জের দ্বিতীয় দিন
জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখকে ‘ইয়াউমে আরাফা’ -আরাফা দিবস বলে। আজ আরাফার মোবারক দিন। মিনা থেকে আরাফা ১৫/১৬ কিলোমিটার দূরত্ব। এইদিন ভোরে ফজরের নামাজ মিনায় আদায় করে তাকবীরে তাশরীক ও তিনবার তালবিয়া পাঠ করুন। তাকবীরে তাশরীক নিম্নরূপঃ
الله أكبر- الله أكبر- لا إله إلا الله- والله أكبر- الله أكبر-و لله الحمد.
(আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবর। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু অ-আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবর। ওলিল্লাহিল্ হাম্দ)।
অর্থঃ আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নাই। আল্লাহ্ মহান, আল্লাহ্ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য।
অতঃপর সূর্যোদয়ের পর ‘তালবিয়া’ পড়া অবস্থায় মু’আল্লিমের গাড়ীতে রওয়ানা হবেন আরাফা অভিমুখে এবং দুপুরের পূর্বেই মিনা থেকে আরাফার ময়দানে পৌঁছান। তবে বর্তমানে হজ্জযাত্রীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ফজরের পূর্বেই নিয়ে যাওয়া হয় আরাফায়। এটা নিশ্চয়ই সুন্নতের খেলাপ। তবে ওজরের কারনে এ সুন্নত ছুটে গেলে কোন সমস্যা হবে না।
দুপুর থেকে ‘উকুফে আরাফা’ শুরু। এ সময় এখানে গোছল করাকে কেউ কেউ মুস্তাহাব বলেছেন। না পারলে ওযুই যথেষ্ট।
৯ জিলহজ্জ ফজর নামাজের পর থেকে ১৩ জিলহজ্জ আসর পর্যন্ত আপনি যেখানেই থাকুন প্রতি ফরজ নামাজের পর ‘তাকবীরে তাশরীক’ পড়ুন এবং এটা ওয়াজিব।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হচ্ছে হজ্জ’। আর এ কারনেই আরাফাতের ময়দানে দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা ফরজ।
জোহর ও আসরের নামাজ জোহরের প্রথম ওয়াক্তে এক আযান ও দু’ইকামাতে মুকিম বা মুসাফির হিসাবে (যার জন্য যেটি প্রযোজ্য) সম্পূর্ন বা কসর আকারে পড়ুন। কেননা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামদেরকে নিয়ে যোহর আসর একসাথে আদায় করেছিলেন। যদি সম্ভব হয় মসজিদে নামিরাতে গিয়ে ইমামের পিছনে জোহর ও আছরের নামাজ একসাথে উপরের নিয়মে পড়বেন এবং নামাজ শেষে আপনার অবস্থানস্থলে ফিরে যাবেন। মনে রাখবেন আরাফাহ্র পুরোটা ময়দানই অবস্থানস্থল।
আরাফায় অবস্থানের সময় বিশেষভাবে লক্ষ রাখবেন যাতে অবস্থান সঠিক হয়। কারন আরাফাত সংলগ্ন ‘আরানা উপত্যকা’ অবস্থিত। সেখানে ‘মসজিদে নামিরা’ অবস্থিত। হাজীদের ভুল করে এই উপত্যকায় অবস্থান করতে দেখা যায়।
আরাফা দিবসের মূল আমল দোয়া। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরাফার ময়দানে উকুফের সময় কেবলামুখী হয়ে হাত উঠিয়ে বিরতিহীনভাবে দোয়া করেছেন। এমনভাবে হাত উঠিয়ে তিনি দোয়া করেছেন যে, একবার উট হেলে যাওয়ার কারনে উটের লাগাম পড়ে যায়। তিনি এক হাত দিয়ে লাগামটি উঠালেন, ও অন্য হাত দোয়ার জন্য উঠিয়েই রাখলেন। সে কারনে ‘উকুফে আরাফার’ সময় আমাদেরও কর্তব্য হাত উঠিয়ে নিরন্তরভাবে দোয়া করে যাওয়া।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, সবচেয়ে উত্তম দোয়া আরাফাহ্ দিনের দোয়া। আর সর্বোত্তম দোয়া হলো এই দোয়া, যা আমি ও আমার পুর্বেকার নবীগন (আঃ) চেয়েছেন। তা হলো এই-
لا إله إلا الله وحده لا شريك له، له الملك وله الحمد وهو على كل شيء قدير-
(লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়দাহু লা শরিকালাহু লাহুল মুল্কু ওলাহুল্ হামদু ও-হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির)
অর্থঃ আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। তিনি এক, তার কোন শরীক নাই। সমস্ত জগতের মালিক তিনি। সমস্ত প্রশংসা তারই জন্য। তিনি সকল বস্তুর উপর পূর্ন ক্ষমতাবান।
এরপর নিম্নের দোয়াগুলি পরপর পড়ুন। সম্ভব হলে ১০০ বার পড়ুন। দোয়াগুলি হলো-
لا إله إلا انت سبحانك انى كنت من الظلمين-
(লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা সুব্হানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ্জলিমিন)
অর্থঃ তুমি ছাড়া কোন মা’বুদ নাই। তুমি পাক পবিত্র। নিশ্চয়ই আমি অত্যাচারীদের অন্তর্ভূক্ত।
سبحان الله والحمد لله و لا اله إلا الله و الله أكبر و لا حول و لا قوة الا بالله العلى العظيم.
(ছুব্হানাল্লাহি ওল্হাম্দুলিল্লাহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওলাহাওলা ও’লাকুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল্ আলিউল আজিম)
অর্থঃ পাক পবিত্র আল্লাহ্। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য। নাই কোন ইলাহ আল্লাহ ছাড়া। আল্লাহ মহান। নাই কোন ক্ষমতা কারও কোন কল্যান করার এবং নাই কোন শক্তি বিপদ আপন দূর করার।
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ - اللَّهُ الصَّمَدُ- لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ - وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ.
(কুল হুয়াল্লাহু আহাদ। আল্লাহুচ্ছামাদ। লাম্ ইয়ালিদ ওলাম্ ইউলাদ্। অলাম ইয়াকুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ।)
অর্থঃ বল, [হে মুহাম্মদ (সাঃ)] তিনি (আল্লাহ) এক, তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাকে ও জন্ম দান করেননি এবং নিজেও জন্মগ্রহন করেননি এবং তার সমকক্ষ কেউ নেই।
এভাবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অনুনয় বিনয়ের সাথে জিকিরও দোয়ার মধ্যে ব্যস্ত থাকুন। এছাড়াও যত কিছু দোয়া আপনার মুখস্ত আছে, তা সব পড়ুন। সাথে ওজিফার কিতাব থাকলে তা পড়ুন। নিজকে নিজে বলুন এমন দিন, এমন মূহুর্ত হয়ত জীবনে আর নাও আসতে পারে। আজকের দিনেও যদি গোনাহ্ মাফ না হয়, তবে আর কবে হবে? নিজের বিগত জীবনের সমস্ত গোনাহ্ মাফ করিয়ে পাক সাফ হতে হবে। চোখের পানি দিয়ে পাপ-তাপ ধুয়ে মুছে পবিত্র হতে হবে। যেমন করে হোক, যেভাবেই হোক আল্লাহ্পাকের নিকট থেকে এই সময়ে নিজের সমস্ত গোনাহ্ মাফ করিয়ে নিতে হবে। দোয়ার শেষে নামাজে আমরা যে দরুদ শরীফ পড়ি তা পড়ুন।
আপনার জন্য একটা বিশেষ পরামর্শ। আপনি যে তাবুতে আছেন, যদি কোন কারনে ঐ তাবুর পরিবেশ ভাল না হয়, তবে পাশ্ববর্তী অন্য তাবুতে অথবা কোন গাছের ছায়ায় বা খোলা আকাশের নীচে (সম্ভব হলে দাঁড়িয়ে) অত্যন্ত একাগ্রচিত্তে ভয় ও ভক্তির সাথে দোয়ায়/এবাদতে মশগুল থাকুন। মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যাপার। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু সাথে থাকলে কান্নাকাটি করতে অনেক সময় অসুবিধা হয়। আরাফাতের প্রতিটি মূহুর্তই অত্যন্ত মূল্যবান। এই বিশ্বাস রাখুন যে, লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে আপনার দোয়াও কবুল হবে, ইনশাআল্লাহ্। এটা দোয়া কবুলের স্থান ও সময়।
যদি সাথে কোন মহিলা থাকেন, তবে তিন চারটি বড় চাদর এবং কিছু সেফটিপিন সাথে রাখুন যেন আরাফার তাবুর মধ্যেই চাদর দিয়ে পর্দা করতে পারেন।
৯ জিলহজ্জ সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দানে বা রাস্তায় কোথাও মাগরিবের নামাজ না পড়ে সোজা মুযদালিফা-র দিকে যাত্রা করুন। কাউকে কোন ধরনের কষ্ট না দিয়ে অত্যন্ত শান্ত ও এত্মিনানের সাথে আল্লাহর যিকিরে মশগুল থেকে পথ চলুন। ভাড়ার গাড়ীতে ৩০/৪০ রিয়ালে বা মুয়াল্লিমের গাড়ীতে আরাফা থেকে মুযদালিফায় যাওয়া সুবিধাজনক। তবে সূর্যাস্তের প্রায় দেড়-দুঘন্টা পরে গাড়ী চলাচল শুরু হয়।
এখানে মনে রাখবেন যে আরাফার সীমানা শেষ হলেই মুয্দালিফা শুরু হয় না। আরাফা থেকে প্রায় ৬ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করার পর আসে মুয্দালিফা। মুয্দালিফার পর ‘ওয়াদি আল-মুহাস্সর’। আরাফা থেকে যেতে দু’পাশে সামনাসামনি দুটি পাহাড় পড়বে। এই পাহাড়দ্বয় থেকে ওয়াদি আল মুহাস্সর পর্যন্ত মুযদালিফা। মুযদালিফার শুরু ও শেষ নির্দেশকারী বোর্ড রয়েছে।
মুযদালিফায় পৌঁছে প্রথম কাজ হলো এশার ওয়াক্তে এক আযান এবং দুই একামত দ্বারা পর্যায়ক্রমে মাগরিবের ফরজ পড়ে এশার ফরজ নামাজ আদায় করুন। এই দুই ফরজ নামাজ একসাথে পড়া এখানে ওয়াজিব। ফরজ আদায়ের পর বেতেরের নামাজ ও আদায় করুন। মুয্দালিফায় নামাজ আদায়ের এটাই বিশুদ্ধ পদ্ধতি। খেয়াল রাখতে হবে যে মুযদালিফায় পৌঁছার পর যদি এশার নামাজের সময় না হয় তবে এশার ওযাক্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে এবং প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তাকবীর-ই-তাশরীক পড়ার কথা স্মরন রাখুন।
নামাজ আদায়ের পর আর কোন কাজ নেই। তাই খাওয়া-দাওয়া শেষে বিশ্রাম নিতে পারেন। কেননা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হজ্জের সময় সুব্হে সাদিক পর্যন্ত শুয়ে আরাম করে গেছেন। তবে শক্তি সামর্থ্য থাকলে মুযদালিফার মসজিদে (আল মাশআরুল হারাম) এসে নামাজ পড়তে পারেন এবং মসজিদের বারান্দা বা আশে-পাশে অবস্থান করতে পারেন। আরো সুবিধা আছে। ঐ মসজিদেই ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করার পর সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত অবস্থান করে যিকির আয্কার ও ইবাদতে সময় অতিবাহিত করা বেশ সুবিধাজনক।
আপনি অবশ্যই মনে রাখবেন যে সুবেহ্ সাদিক থেকে সূর্যোদয়ের পূর্ব সময়ের মধ্যে কিছুক্ষন মুযদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। কাজেই মুযদালিফার মসজিদে বা উহার কাছে গিয়েই হোক বা আপনি যেখানে অবস্থান করছেন, সেখানেই হোক ফজরের নামাজ আদায়ের পর হাত উঠিয়ে দোয়ায় মশগুল হবেন ও খুব ফর্সা হওয়া পর্যন্ত দোয়া ও যিকির চালিয়ে যাবেন। আরাফাতে অবস্থানকালে যে দোয়া পড়েছিলেন এখানেও সেই দোয়া পড়তে পারেন। এরপর সূর্যোদয়ের আগেই মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন।
পরামর্শঃ মুযদালিফায় অবস্থানকালে এক ফাঁকে কংকর কুড়িয়ে নিতে পারেন। কেননা মিনায় গিয়ে কংকর খুজে পাওযা রীতিমত কষ্টের ব্যাপার। তবে মুযদালিফা থেকেই কংকর নিতে হবে এ ধারনা ঠিক নয়। মটরশুঁটি আকারের কংকর নেবেন যা আংগুল দিয়ে নিক্ষেপ করা যায়। ৭০(সত্তর)টি কংকর কুঁড়াবেন। কংকর পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে এমন কোন বিধান নেই।
১০ জিলহজ্জঃ ঈদের দিন
হজ্জের তৃতীয় দিন
আজ ১০ জিলহজ্জ। হজ্জের বড় দিন- বছরের সর্বোত্তম দিবস। মিনায় পৌঁছে এই দিনে আপনি হজ্জের চারটি কাজ করবেন। সেগুলো নিম্নরূপঃ
১. জামারায়ে আকাবা বা বড় শয়তানের গায় ৭(সাত)টি কংকর নিক্ষেপ করবেন (ওয়াজিব);
২. কুরবানী করবেন;
৩. মাথা মুন্ডন বা চুল ছোট করবেন ও ইহ্রাম ছেড়ে সাধারন পোশাক পরবেন এবং
৪. কাবা শরীফ তাওয়াফে জিয়ারত করবেন এবং সাফা-মারওয়া সাঈ করবেন এবং জিয়ারত শেষে মিনাতে রাত্রি যাপন করার জন্য ফিরে আসবেন। এটি এদিন না পারলেও তা ১১ বা ১২ তারিখেও করতে পারবেন।
কংকর নিক্ষেপ
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সূর্য ওঠার প্রায় দেড়-দুই ঘন্টাপর কংকর মেরেছিলেন। সে হিসাবে এ সময়টাতেই ১০ তারিখের কংকর নিক্ষেপ করা সুন্নত। সূর্য ঢলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এ সুন্নত সময় চলতে থাকে। তবে সূর্য ঢলে যাওয়া থেকে শুরু করে ১১ তারিখের সুব্হে সাদিকের আগ পর্যন্তও বড় জামরায় কংকর মারা জায়েজ। বর্তমান যুগে বিশ লক্ষাধিক হজ্জ পালনকারীর ভিড়ে সুন্নত আদায় করা অনেকের পক্ষেই কষ্টকর। তাই প্রথমে খবর নিন, কখন ভিড় কম থাকে। অনেক সময় সকাল বেলা ভিড় কম থাকে। কেননা অনেকেই ভাবেন যে, এখন মনে হয় প্রচন্ড ভিড়, তাই পরে যাই। আবার অনেক সময় সকাল বেলায় প্রচন্ড ভিড় থাকে। তাই আপনার উচিৎ হবে, ভিড় আছে কিনা তা খবর নিয়ে দেখা। তবে ১০ জিলহজ্জ সূর্যোদয় থেকে শুরু করে ১১ জিলহজ্জ সুবেহ সাদিক উদয়ের আগ পর্যন্ত ১০ তারিখের কংকর মারা চলে, এটাই আপনি মাথায় রাখুন। তাই এই সময়ের মধ্যে যখন ভিড় কম বলে খবর পাবেন, তখনই কংকর মারতে যাবেন।
নারীদের জন্য বিকেলবেলা ও রাতে কংকর মারা সহজ। কেননা, ঐ সময়ে সাধারনত লোক সমাগম কম থাকে। তবে যারা দূর্বল, অর্থাৎ হাটা-চলায় সামর্থ্য রাখে না, তারা নিজের কংকর অন্যকে দিয়ে মারাতে পারেন। এক্ষেত্রে যিনি প্রতিনিধি হবেন, তাকে অবশ্য হজ্জ পালনকারী হতে হবে এবং নিজের কংকর প্রথমে মেরে পরে অন্যেরটা মারবেন।
এখন কংকর মারার জন্য তালবিয়া পড়ে পড়ে বড় জামরার দিকে অগ্রসর হন। মিনার দিক থেকে তৃতীয় আর মক্কার দিক থেকে প্রথম জামরাকে জামরায়ে আকাবা বা বড় শয়তান বলে। কংকর মারার নিয়ম হচ্ছে, কংকর নিক্ষেপের সময় মিনাকে ডান দিকে এবং কাবাকে বাম দিকে রেখে দাঁড়ান। শাহাদাৎ ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা কংকর ধরে চিহ্ন থেকে অন্তঃত ৫(পাঁচ) হাত দুরে দাঁড়িয়ে স্তম্ভের জায়গায় কংকর নিক্ষেপ করুন। প্রথম কংকর মারার পুব মূহুর্তে তালবিয়া পড়া বন্ধ করে দিন। প্রতিটি কংকর ভিন্ন ভিন্নভাবে মারার সময় বলুনঃ বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর। স্তম্ভের চারপার্শে বৃত্তাকারে সীমা নির্ধারন করে দেয়া জায়গাটির ভিতরেই কংকর পড়তে হবে। যদি কোন কংকর এর ভিতরে না পড়ে কিংবা সজোরে স্তম্ভে লেগে বাইরে ছিটকে পড়ে, আরেকটি কংকর নিক্ষেপ করতে হবে, নতুবা কাফ্রার দিতে হবে।
কুরবানী
বড় জামরায় কংকর মারা শেষ করে হজ্জের শোকরিয়া হিসাবে কুরবানী করা ওয়াজিব। নিজ হাতে করুন কিংবা কাউকে পাঠান; তবে যবেহ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হোন। মিনায় কোরবানী করতে না পারলে মক্কা শহরেও কুরবানী করতে পারেন, জায়েজ আছে। উট-গরু-বকরি-মেষ কোরবানী হিসাবে যবেহ করা যায়। উট হলে ৫ বছর বয়সের, গরু হলে ২ বছর বয়সের ও মেষ হলে ১ বছর বয়সের হতে হবে। উট ও গরু হলে একটাতে ৭জন অংশ নিতে পারবেন। বকরি ও ভেড়ার ক্ষেত্রে একটি পশু একজনের কোরবানী হিসাবে যবেহ করবেন।
মাথা মুন্ডন
পশু কুরবানীর পর মাথা মুন্ডন বা চুল ছোট করুন। তবে মুন্ডন করাই উত্তম। মাথা মুন্ডানো হোক বা চুল ছোট করা হোক সমস্ত মাথা ব্যাপ্ত করা সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সমস্ত মাথা ব্যাপ্ত করে মুন্ডন করেছিলেন। মাথার কিছু অংশ মুন্ডন করা অথবা ছোট করা, আর কিছু অংশ ছেড়ে দেয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর আদর্শের বিপরীত।
আপনার মাথা মুন্ডনের কাজটি মিনায় হওয়া সুন্নত। কেবলামুখী হয়ে বসা এবং ডানদিক থেকে চুল ছাটা ও সুন্নত। মহিলাগন তখনি তাদের চুলের আগা থেকে এক গিরা বা ততোধিক পরিমান কাটবেন, যখন পুরুষেরা কোরবানী করে ফিরে এসে তাদেরকে বলবেন।
মাথা মুন্ডনের পর আপনি হালাল হয়ে গেলেন। এবার ইহ্রাম খুলে নিন। কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্ক এখনও নিষিদ্ধ। তাওয়াফে জিয়ারতের পর জায়েজ।
তাওয়াফে জিয়ারত
১০ জিলহজ্জের চতুর্থ আমল হলো তাওয়াফে জিয়ারত। তাওয়াফে জিয়ারত ১০ তারিখেই সেরে নেয়া ভালো। কিন্তু ১০ তারিখ সম্ভব না হলে ১১ বা ১২ তারিখের সূর্যাস্তের পূর্বে অবশ্যই এ তাওয়াফ করতে হবে। কংকর নিক্ষেপ, কুরবানী করা এবং ক্ষৌরকার্য এ তিনটি আমল শেষ করে গোছল করে, সুগন্ধি মেখে সেলাইযুক্ত কাপড় পড়ে আপনি কাবার দিকে রওয়ানা হবেন। শুরুতে ওমরা আদায়ের সময় যে নিয়মে তাওয়াফ করেছেন, ঠিক সে নিয়মেই তাওয়াফ করবেন। তবে এ তাওয়াফে রামল ও ইযতেবা নেই। এ তাওয়াফটি হলো হজ্জের ফরজ তাওয়াফ। তাওয়াফের পর উমরাহ্ অধ্যায়ে বর্নিত পদ্ধতিতে সাফা-মারওয়ার সাঈ করবেন।
মহিলারা হায়েজ অবস্থায় জিয়ারত করতে পারবেন না। যখন পবিত্র হবেন, তখন তাওয়াফে জিয়ারত করবেন। এজন্য দম দিতে হবে না। তবে যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে মাসিক বন্ধ হওয়ার সময় পর্যন্ত কোনক্রমেই অপেক্ষা করা যাচ্ছে না, ও পরবর্তীতে এসে তাওয়াফে জিয়ারত আদায় করে নেয়ারও সুযোগ নেই, তাহলে ন্যাপকিন দিয়ে ভাল করে বেঁধে তাওয়াফে জিয়ারত সেরে নেয়া বৈধ আছে।
তাওয়াফ এবং সাঈ শেষ করে মিনায় ফিরে আসবেন। ১০ তারিখ দিবাগত রাত ও ১১ তারিখ দিবাগত রাত মিনায় অবস্থান করা ওয়াজিব। আবার ১২ তারিখ যদি মিনায় থাকা অবস্থায় সূর্য ডুবে যায়, তাহলে ১২ তারিখ দিবাগত রাতেও মিনায় থাকা ওয়াজিব হয়ে যায়। ১৩ তারিখ কংকর মেরে তারপর মিনা ত্যাগ করবেন।
১১ জিলহজ্জঃ আইয়ামে তাশরীকের ১ম দিন
হজ্জের চতুর্থ দিন
১১ জিলহজ্জ সূর্য ঢলে যাবার পর তিন জামরায়ে কংকর নিক্ষেপ করবেন। প্রথমে ছোট জামরায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করবেন। কাবা শরীফ বামে ও মিনা ডানে রেখে দাঁড়াবেন। খুশু খুজুর সাথে আল্লাহ্র শিয়ারের-নিদর্শনের যথাযথ তাজিম বুকে নিয়ে একটি একটি করে কংকর নিক্ষেপ করবেন। ‘আল্লাহু আকবর’- বলে প্রতিটি কংকর নিক্ষেপ করবেন। ছোট জামরায় কংকর মারা শেষ হলে একটু সামনে এগিয়ে যাবেন। কেবলামুখী হয়ে দাড়াবেন ও হাত উঠিয়ে দীর্ঘ মোনাজাত করবেন। এরপর মধ্য জামরায় যাবেন। এখানেও ৭টি কংকর একই কায়দায় নিক্ষেপ করবেন। নিক্ষেপের পর সামান্য এগিয়ে কেবলামুখী হয়ে দাড়িয়ে আবার দীর্ঘ মোনাজাত করবেন। এরপর বড় জামরায় কংকর মারতে যাবেন। নিয়মমত এখানেও ৭টি কংকর মারবেন। তবে এবার আর কোন দোয়া করবেন না। কেননা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বড় জামরায় কংকর মারার পর আর দাড়াননি। কংকর মারা শেষ হলে তাবুতে ফিরে যাবেন।
১২ জিলহজ্জঃ আইয়ামে তাশরীকের ২য় দিন
হজ্জের পঞ্চম দিন
ঠিক গতকালের মত দুপুরের পর প্রথমে ছোট, তারপর মধ্যম, তারপর বড় জামরায় ৭টি করে মোট ২১টি কংকর মারবেন। ছোট ও মধ্যম জামরায়ে কংকর মারার পর কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘ মোনাজাত করবেন। আপনি ইচ্ছা করলে এই তারিখে পাথর মেরে সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে পারেন। তাই দেখা যায় অনেকেই ১২ তারিখে মক্কায় ফিরে যান। সেজন্য তাড়াহুড়া করতে গিয়ে দুপুরের আগেই কংকর মেরে ফেলেন; অথচ এটা নাজায়েজ। দুপুরের পরে পুনরায় তাদের কংকর নিক্ষেপ করতে হবে, নতুবা দম দিতে হবে।
১৩ জিলহজ্জঃ আইয়ামে তাশরীকের ৩য় দিন
হজ্জের ৬ষ্ঠ দিন
১২ জিলহজ্জ মিনায় থাকা অবস্থায় সূর্য ডুবে গেলে মিনাতেই রাত কাটাতে হবে এবং ১৩ তারিখ দুপুরের পর পূর্ব বর্নিতভাবে পর্যায়ক্রমে ছোট, মধ্যম ও বড় জামরায় কংকর মেরে মক্কা শরীফে ফিরে আসবেন। মক্কায় পৌছার পর বিদায়ী তাওয়াফ ছাড়া হজ্জের জন্য আর কোন জরুরী কাজ বাকী নাই। আপনি ইচ্ছা করলে ১৪ জিলহজ্জ হতে মসজিদে আয়শা (তানয়ীম) থেকে ইহ্রাম বেঁধে নফল উমরাহ্ করতে পারেন।
মক্কা শরীফ থেকে বিদায়ের পূর্বে বিদায়ী তাওয়াফ করা ওয়াজিব। এতে ইজতেবা, রমল ও সাঈ নেই।
বিদায়ী তাওয়াফের সময় যদি কোন মহিলা হায়েজ অবস্থায় থাকেন এবং তার পাক হওয়া পর্যন্ত মুহরিম ব্যক্তি যদি বিলম্ব করতে অপারগ হন, তাহলে ঐ মহিলার উপর বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব থাকবে না। তার উচিৎ কাবা শরীফে প্রবেশ না করে দরজার নিকট দাড়িয়ে দোয়া চেয়ে রওয়ানা হয়ে যাওয়া।
তাওয়াফ শেষে যমযম পানি পান করার পর ‘হাজরে আসওয়াদ’ এ সম্ভব হলে চুমু দিয়ে বা হাতে স্পর্শ করে সায়ীর উদ্দেশ্যে মনে মনে নিয়ত বা প্রতিজ্ঞা করুন যে, “হে আল্লাহ, আমি আপনার সন্তুষ্টির জন্য সাফা ও মারওয়ার সাঈ করার নিয়ত করছি। ইহা আমার জন্য সহজ করে দিন এবং কবুল করুন” এবং সাফা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হোন। চুম্বন বা স্পর্শ সম্ভব না হলে এক্ষেত্রে ‘হাজরে আসওয়াদ’ এর দিকে ইশারা করার কোন বিধান নেই।
সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অনুসরনে বলুন
ان الصفا و المروة من شعاءر الله – ابدء بما بدء الله به-
(ইন্নাস্ সাফা ওয়াল মার্ওয়াতা মিন্ শা’আ’ইরিল্লাহি, আব্দায়ু বিমা বাদাআল্লাহু বিহি)।
অর্থ : নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন সমুহের মধ্যে অন্যতম। আমি শুরু করছি আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন।
এই দোয়াটি এখানে ছাড়া আর কোথাও পড়বেন না। সা’ঈর প্রথম চক্রের শুরুতেই শুধুমাত্র পড়বেন। প্রতিচক্রে বারবার এটা পুনরাবৃত্তি করবেন না।
এরপর যতটুকু সম্ভব সাফা পাহাড়ের উপরে এতটুকু উঠুন যেন কাবা শরীফ নজরে পড়ে।(এখন আর পাহাড় নেই; মেঝেতে মার্বেল পাথর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।) তারপর কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দুই হাত পর্যন্ত তুলে তিনবার তাকবির বলে (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার) নিচের দোয়াটি তিনবার পড়ুন-
لا إله إلا الله - الله اكبر- لا إله إلا الله - وحده - لا شريك له- له الملك- وله الحمد – يحيى و يميت - وهوا على كل شيء قدير.
(লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ , আল্লাহু আকবার। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াহ্দাহু, লা-শারী’কালাহু। লাহুল্ মুল্ক, ওয়া লাহুল্ হাম্দ। ইউহ্’ঈ ও ইউ-মিতু, ও হুয়া আ-লা কুল্লে শাইয়েন কাদির।)
অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নাই । আল্লাহ মহান । তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নাই। তিনি এক ও একক। তার কোন শরীক নাই। সার্বেভৌমত্বের তিনিই মালিক। সমস্ত প্রশংসা তারই জন্য। তিনি জীবন ও মৃত্যু দিয়ে থাকেন এবং তিনি সর্বময় ক্ষমতার মালিক।
মনে রাখবেন, এই গুরুত্বপূর্ন দোয়াটি পরবর্তীতে মিনা, আরাফা এবং মুজদালিফায় বহুবার পড়তে হবে।
এই দোয়াটি পড়ার পর যত পারেন দুনিয়া ও আখেরাতের অসংখ্য কল্যান চাইতে থাকুন। আরবী ভালভাবে না বুঝলে নিজের ভাষায় আল্লাহর প্রশংসা করুন ও আপনার বৈধ ইচ্ছাগুলো তার দরবারে পেশ করুন। দোয়া শেষ হলে ‘সাফা’ থেকে নেমে ‘মারওয়ার’ দিকে হাটতে থাকুন। আর আল্লাহর যিক্র ও দোয়া করতে থাকুন। নিজের জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য এবং মুসলিম মিল্লাতের সবার জন্য। সাফা থেকে নেমে কিছু দূর এগুলেই উপরে ও ডানে-বামে সবুজ বাতি জ্বালানো দেখবেন। এই সবুজ বাতি জ্বালানোর প্রথম জায়গা/আলামত থেকে পরবর্তী সবুজ বাতি পর্যন্ত পুরুষ হাজীগন দৌঁড়ানোর মত করে দ্রুত গতিতে হেঁটে চলুন (এটা সেই জায়গা যেখানে হযরত হাজেরা (রাঃ) পানির জন্য দৌড়েছিলেন) এবং শেষ সবুজ বাতির আলামতের পরে চলার গতি আবার স্বাভাবিক করুন। তবে নারীদের ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় চলার গতি স্বাভাবিক থাকবে।
সবুজ দুই আলামতের মাঝে চলার সময় নিচের দোয়াটি পড়ুন-
رب اغفر – وارحم - و انت الاعذ الاكرام.
(রাব্বিগ্ফির ওয়ার্হাম ওয়া-আন্তাল্ আ-আজ্জুল্ আক্রাম)
অর্থ : হে আমার রব ! আমাকে ক্ষমা করে দাও ! তুমিতো মহা সম্মানের অধিকরী।
এভাবে হেঁটে মারওয়া পাহাড়ে পৌছে এর উঁচুতে আরোহন করুন। অতঃপর পবিত্র কাবার দিকে মুখ করে ‘সাফা’ পাহাড়ে যা যা পড়েছিলেন ও করেছিলেন সেগুলো এখানেও একই কায়দায় হাত তুলে তিনবার করুন। অর্থাৎ তিনবার ‘আল্লাহ আকবার’ তাকবীর বলে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ও আল্লাহু আকবর” থেকে “ও হুয়া আ-লা কুল্লে শাইয়েন কাদির’- পর্যন্ত পুরাটা তিনবার পড়ুন, অতঃপর দোয়া করুন। ‘সাফা’ থেকে ‘মারওয়া’ য় আসার পর আপনার একচক্র শেষ হলো।
এবার আপনি ‘মারওয়া’ থেকে নেমে আবার ‘সাফার’ দিকে চলতে থাকুন। সবুজ চিহ্নিত দুই বাতির আলামতের মধ্যবর্তী স্থানে পুরুষ হাজীরা আগের মত দৌড়ানোর মত করে দ্রুত গতিতে হেটে চলুন এবং সবুজ বাতির শেষে চলার গতি আবার স্বাভাবিক করুন। ‘সাফা’ পাহাড়ে পৌছে প্রথমবার যা যা পড়েছিলেন ও করেছিলেন এবার ও তা পড়ুন ও করুন। এভাবে প্রত্যেক চক্রেই এ নিয়ম পালন করে যান। ‘সাফা’ থেকে ‘মারওয়া’ গেলে হয় এক চক্র। আবার ‘মারওয়া’ থেকে ‘সাফায়’ ফিরে এলে হয় আরেক চক্র। এভাবে ৭(সাত) চক্র পূর্ণ করুন।
‘সাফা’ থেকে ‘মারওয়া’-র দূরত্ব প্রায় ৪৫০ মিটার - অর্থাৎ ৭(সাত) চক্কর দিলে (একবার সা’ঈ করলে) তিন কিলোমিটারের একটু বেশী পথ অতিক্রম করা হবে।
‘সাফা’ ও ‘মারওয়া’ -উভয়টা দোয়া কবুলের জায়গা। কাজেই ‘সাঈ’-র পথ বেশী মনে করে তাড়াতাড়ি ‘সাঈ’ সেরে নিয়ে বাসায় চলে যাবার চিন্তা করবেন না। ধীরে-সুস্থে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যেখানে যা করেছিলেন, সেখানে সেটা সেভাবেই করার চেষ্টা করুন। কতটুকু করলে ফরজ আদায় হয়ে যাবে এই চিন্তা মাথায় আনবেন না। বরং এটা টার্গেট বানাবেন যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কোথায় কোন কাজ কিভাবে ও কত সময় করেছন, আমি ও ঠিক সেভাবেই করব।
‘সাঈ’ করার সময় সালাত দাঁড়িয়ে গেলে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করুন। ‘সাঈ’ করার সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসে আরাম করে নিন। এতে ‘সাঈ’ করার কোন ক্ষতি হবে না।
‘তাওয়াফ’ করার সাথে সাথেই ‘সাঈ’ জরুরী নয়। তবে ‘তাওয়াফ’ করার সাথে সাথেই ‘সাঈ’ করা সুন্নত। যদি কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়ে বা অন্য কোন শারীরিক অসুবিধার কারনে কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে যায় তা বৈধ।
‘সাঈ’ পায়ে হেঁটে করা ‘ওয়াজিব’। যদি কোন অসুবিধা থাকে তাহলে ট্রলিযোগে ‘সাঈ’ করা যাবে।
উম্রার চতুর্থ কাজঃ হলক (ওয়াজিব)
‘সা’ঈর’ কাজ শেষ করার পর এখন আপনার আমল হচ্ছে ‘হলক’ করা। যার অর্থ সম্পূর্ন মাথা মুন্ডানো বা ছাঁটা। কমপক্ষে পুরুষ হাজীদের মাথার সমস্ত চুলের এক-চুতর্থাংশ ছেঁটে ফেলে দিতেই হবে। সাবধানতার জন্য একটু বেশী ছাঁটুন। সেলুনে গিয়ে চুল কামিয়ে বা মেশিন দিয়ে ছেঁটে নেয়া সুবিধাজনক। মারওয়া পাহাড়ের কাছেই চুল কাটার অনেক সেলুন রয়েছে।
মনে রাখা জরুরী যে চুল ছোট করে কাঁটার চেয়ে মাথা মুন্ডন করার মধ্যে সাওয়াব বেশী। কেননা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মাথা মুন্ডনকারীদের জন্য তিনবার রহমত ও মাগফিরাতের দোয়া করেছেন। অন্যদিকে যারা চুল খাট করে কেঁটেছেন, তাদের জন্য মাত্র একবার উক্ত দোয়া করেছেন।
মহিলাদের জন্য মাথা মুন্ডনের কোন বিধান নেই। তারা ‘সা’ঈ’ শেষে আপন আপন বাসস্থানে গিয়ে মাথার সব চুলের অগ্রভাগ থেকে আঙ্গুলের এক কড়া পরিমান (অর্থাৎ এক ইঞ্চির একটু কম পরিমান) চুল কেটে ফেলুন। স্মরন রাখতে হবে যে, মহিলারা এর চেয়ে বেশী পরিমান চুল কাটবে না এবং চুল নিজে কেঁটে ফেলুন বা কোন মহিলা দ্বারা বা মাহ্রাম ব্যক্তির দ্বারা কেঁটে নিন। কোন বেগানা পুরুষকে দিয়ে কাটানো হারাম।
এখন আপনি উম্রার ইহ্রাম থেকে হালাল হয়ে গেলেন। কাজেই ইহ্রামের পোশাক খুলে স্বাভাবিক পোশাক পরে নিন। এরপর হজ্বের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকুন।
তবে এখানে বিশেষভাবে স্মরন রাখার মত, মুল হজ্ঝ শুরুর আগে অর্থ্যাৎ আট জিলহজ্জের আগে এবং ওমরা পালন শেষে সাথে সাথে সম্ভব হলে কমপক্ষে একটি নফল তাওয়াফের সংগে একটি সাঈ করে নেওয়া উত্তম।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস থেকে বর্নিত- তিনি বলেন নবী করিম (সাঃ) এরশাদ করেছেন- আল্লাহ্তায়ালা প্রত্যেক দিন ও রাত মসজিদে হারামের প্রতি ১২০টি রহমত বর্ষন করে থাকেন। তন্মধ্যে এই ঘরের তাওয়াফকারীগনের প্রতি ৬০টি, এতে নামাজ আদায়কারীগন মুসল্লীদের প্রতি ৪০টি এবং এই ঘরের প্রতি দৃষ্টিদানকারীগনের প্রতি ২০টি রহমত দান করেন। সুতরাং মক্কাশরীফে অবস্থানকালে অধিক পরিমানে তাওয়াফ করতে থাকুন, কেননা এই তাওয়াফ দুনিয়ার আর কোথাও নাই।
হজ্জ পালনে কাজের ধারাবাহিকতাঃ দিনওয়ারী হজ্জের করনীয় কাজ
বাংলাদেশের মানুষ সাধারনতঃ ‘তামাত্তো হজ্জ’ করে থাকেন। হজ্জের মাসসমূহে (শাওয়াল, যিলক্বদ ও জিলহজ্জ) উম্রার ইহ্রাম বেঁধে প্রথমে উম্রা পালন করে ইহ্রাম খুলে ফেলা; অতঃপর হজ্জের জন্য পুনরায় ইহ্রাম বেঁধে হজ্জ সম্পন্ন করাকে ‘তামাত্তো হজ্জ’ বলে।
৮ জিলহজ্জ থেকে ১২ জিলহজ্জ পর্যন্ত এই পাঁচ দিনকে ‘আইয়ামে হজ্জ’ বা হজ্জের দিন বলা হয়। এই দিনগুলোতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ন রোকন- হজ্জ পালন করা হয়। ৮ তারিখ সকালে হাজী সাহেবানরা ৪/৫ দিনের উপযোগী ‘প্রবাস সরঞ্জাম’ নিয়ে মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য প্রস্তুত থাকেন। মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব ৪/৫ কিলোমিটার।
৮ জিলহজ্জঃ তারওয়ীয়াহ্র দিন
হজ্জের প্রথম দিন
আজ থেকে হজ্জের পাঁচদিন আরম্ভ হল। আপনি বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে একজন ‘তামাত্তো হজ্জ’ পালনকারী। তাই ওমরাহ্র সময় যেভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ইহ্রাম বেঁধেছিলেন, আপনার হোটেল বা বাসা থেকেই সেভাবে ইহ্রাম বাঁধুন। (তবে কুরবানীকারীরা ১লা জিলহজ্জ থেকে কোরবানীর পূর্ব পর্যন্ত চুল-নখ কাটবেন না।) ইহ্রাম বাঁধার সময় এভাবে নিয়ত করুন- لبيك حجا (লাব্বাইকা হাজ্জ্বান) অর্থঃ হে আল্লাহ আমি হজ্জ্বের জন্য প্রস্তুত) নিয়তের সাথে সাথে নিম্মের দোয়া পড়ুনঃ
اللهم انى اريد الحج قيسره لي و تقبله منى-
(“আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল হাজ্জা ফাইয়াস্সিরহুলি ওয়া তাকাব্বাল্হু মিন্নি”।)
অর্থঃ হে আল্লাহ, আমি হজ্জ পালন করার নিয়ত করছি। আপনি আমার এই হজ্জ আমার জন্য সহজ করে দিন এবং তা কবুল করে নিন।
দোয়া শেষ হওয়ার সাথে সাথে তিনবার তালবিয়া অর্থাৎ “লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, .................. “ একটু উচ্চস্বরে পড়ুন। (মহিলারা নীরবে পড়ুন)।
মনে রাখবেন যে হজ্জের জন্য ইহ্রাম বাঁধা ফরজ। তাই ইহ্রামের নিয়তের সাথে সাথে অবশ্যই তালবিয়া পাঠ করবেন। অন্যথায় ইহ্রাম শুদ্ধ হবে না এবং ইহ্রাম শুদ্ধ না হলে হজ্জ সহীহ্ হবে না।
এভাবে হজ্জের ইহ্রাম বাঁধা হয়ে গেল। সর্বদা তালবিয়া পাঠ করতে থাকুন এবং মোয়াল্লেমের গাড়ীর অপেক্ষায় থাকুন। সতর্ক থাকুন, যেন কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ না হয়। অনর্থক কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকুন। তারপর গাড়ী আসলে তালবিয়া পড়ে পড়ে মিনার দিকে রওয়ানা হন।
সূর্যোদয়ের পর মিনার দিকে রওয়ানা হওয়া সুন্নত। তাই চেষ্টা করুন, এ সুন্নতটি যেন ছুটে না যায়। তবে যদি মুয়াল্লেমের গাড়ী আগেই চলে আসে, তবে সূর্যোদয়ের আগেই চলে যান। এতে কোন সমস্যা হবে না। তবে এ দিন জোহরের আগেই মিনায় পৌঁছে জোহরের নামাজ পড়বেন। অতঃপর আসর, মাগ্রিব ও এশা এবং ৯ জিলহজ্জ ফরজ নামাজ আদায় করবেন। আপনি মুসাফির না মুকিম সে কথা বিবেচনায় রেখে চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজ দু’রাকাত করে কসর অথবা পুর্নাংগ আকারে পড়ুন। ৮ জিলহজ্জের আগে যদি আপনি মক্কা শরীফে মুকীম হিসাবে কমপক্ষে ১৫ দিন অবস্থান করে থাকেন, তবে মিনা, আরাফা ও মুজদালিফায় পুরো নামাজ পড়বেন। আর তা না হলে এসব স্থানে কসর পড়বেন। প্রতি বছরই এই মাসয়ালা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়।
৮ জিলহজ্জ দুপুর থেকে ৯ জিলহজ্জ ফজর বাদ সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। এ সময়ে বেশী বেশী কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার এবং মুসলিম উম্মার জন্য আল্লাহ্র কাছে রহমত কামনা করুন।
৯ জিলহজ্জঃ উকুফে আরাফা
হজ্জের দ্বিতীয় দিন
জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখকে ‘ইয়াউমে আরাফা’ -আরাফা দিবস বলে। আজ আরাফার মোবারক দিন। মিনা থেকে আরাফা ১৫/১৬ কিলোমিটার দূরত্ব। এইদিন ভোরে ফজরের নামাজ মিনায় আদায় করে তাকবীরে তাশরীক ও তিনবার তালবিয়া পাঠ করুন। তাকবীরে তাশরীক নিম্নরূপঃ
الله أكبر- الله أكبر- لا إله إلا الله- والله أكبر- الله أكبر-و لله الحمد.
(আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবর। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু অ-আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবর। ওলিল্লাহিল্ হাম্দ)।
অর্থঃ আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নাই। আল্লাহ্ মহান, আল্লাহ্ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য।
অতঃপর সূর্যোদয়ের পর ‘তালবিয়া’ পড়া অবস্থায় মু’আল্লিমের গাড়ীতে রওয়ানা হবেন আরাফা অভিমুখে এবং দুপুরের পূর্বেই মিনা থেকে আরাফার ময়দানে পৌঁছান। তবে বর্তমানে হজ্জযাত্রীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ফজরের পূর্বেই নিয়ে যাওয়া হয় আরাফায়। এটা নিশ্চয়ই সুন্নতের খেলাপ। তবে ওজরের কারনে এ সুন্নত ছুটে গেলে কোন সমস্যা হবে না।
দুপুর থেকে ‘উকুফে আরাফা’ শুরু। এ সময় এখানে গোছল করাকে কেউ কেউ মুস্তাহাব বলেছেন। না পারলে ওযুই যথেষ্ট।
৯ জিলহজ্জ ফজর নামাজের পর থেকে ১৩ জিলহজ্জ আসর পর্যন্ত আপনি যেখানেই থাকুন প্রতি ফরজ নামাজের পর ‘তাকবীরে তাশরীক’ পড়ুন এবং এটা ওয়াজিব।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হচ্ছে হজ্জ’। আর এ কারনেই আরাফাতের ময়দানে দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা ফরজ।
জোহর ও আসরের নামাজ জোহরের প্রথম ওয়াক্তে এক আযান ও দু’ইকামাতে মুকিম বা মুসাফির হিসাবে (যার জন্য যেটি প্রযোজ্য) সম্পূর্ন বা কসর আকারে পড়ুন। কেননা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামদেরকে নিয়ে যোহর আসর একসাথে আদায় করেছিলেন। যদি সম্ভব হয় মসজিদে নামিরাতে গিয়ে ইমামের পিছনে জোহর ও আছরের নামাজ একসাথে উপরের নিয়মে পড়বেন এবং নামাজ শেষে আপনার অবস্থানস্থলে ফিরে যাবেন। মনে রাখবেন আরাফাহ্র পুরোটা ময়দানই অবস্থানস্থল।
আরাফায় অবস্থানের সময় বিশেষভাবে লক্ষ রাখবেন যাতে অবস্থান সঠিক হয়। কারন আরাফাত সংলগ্ন ‘আরানা উপত্যকা’ অবস্থিত। সেখানে ‘মসজিদে নামিরা’ অবস্থিত। হাজীদের ভুল করে এই উপত্যকায় অবস্থান করতে দেখা যায়।
আরাফা দিবসের মূল আমল দোয়া। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরাফার ময়দানে উকুফের সময় কেবলামুখী হয়ে হাত উঠিয়ে বিরতিহীনভাবে দোয়া করেছেন। এমনভাবে হাত উঠিয়ে তিনি দোয়া করেছেন যে, একবার উট হেলে যাওয়ার কারনে উটের লাগাম পড়ে যায়। তিনি এক হাত দিয়ে লাগামটি উঠালেন, ও অন্য হাত দোয়ার জন্য উঠিয়েই রাখলেন। সে কারনে ‘উকুফে আরাফার’ সময় আমাদেরও কর্তব্য হাত উঠিয়ে নিরন্তরভাবে দোয়া করে যাওয়া।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, সবচেয়ে উত্তম দোয়া আরাফাহ্ দিনের দোয়া। আর সর্বোত্তম দোয়া হলো এই দোয়া, যা আমি ও আমার পুর্বেকার নবীগন (আঃ) চেয়েছেন। তা হলো এই-
لا إله إلا الله وحده لا شريك له، له الملك وله الحمد وهو على كل شيء قدير-
(লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়দাহু লা শরিকালাহু লাহুল মুল্কু ওলাহুল্ হামদু ও-হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির)
অর্থঃ আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। তিনি এক, তার কোন শরীক নাই। সমস্ত জগতের মালিক তিনি। সমস্ত প্রশংসা তারই জন্য। তিনি সকল বস্তুর উপর পূর্ন ক্ষমতাবান।
এরপর নিম্নের দোয়াগুলি পরপর পড়ুন। সম্ভব হলে ১০০ বার পড়ুন। দোয়াগুলি হলো-
لا إله إلا انت سبحانك انى كنت من الظلمين-
(লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা সুব্হানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ্জলিমিন)
অর্থঃ তুমি ছাড়া কোন মা’বুদ নাই। তুমি পাক পবিত্র। নিশ্চয়ই আমি অত্যাচারীদের অন্তর্ভূক্ত।
سبحان الله والحمد لله و لا اله إلا الله و الله أكبر و لا حول و لا قوة الا بالله العلى العظيم.
(ছুব্হানাল্লাহি ওল্হাম্দুলিল্লাহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওলাহাওলা ও’লাকুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল্ আলিউল আজিম)
অর্থঃ পাক পবিত্র আল্লাহ্। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য। নাই কোন ইলাহ আল্লাহ ছাড়া। আল্লাহ মহান। নাই কোন ক্ষমতা কারও কোন কল্যান করার এবং নাই কোন শক্তি বিপদ আপন দূর করার।
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ - اللَّهُ الصَّمَدُ- لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ - وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ.
(কুল হুয়াল্লাহু আহাদ। আল্লাহুচ্ছামাদ। লাম্ ইয়ালিদ ওলাম্ ইউলাদ্। অলাম ইয়াকুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ।)
অর্থঃ বল, [হে মুহাম্মদ (সাঃ)] তিনি (আল্লাহ) এক, তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাকে ও জন্ম দান করেননি এবং নিজেও জন্মগ্রহন করেননি এবং তার সমকক্ষ কেউ নেই।
এভাবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অনুনয় বিনয়ের সাথে জিকিরও দোয়ার মধ্যে ব্যস্ত থাকুন। এছাড়াও যত কিছু দোয়া আপনার মুখস্ত আছে, তা সব পড়ুন। সাথে ওজিফার কিতাব থাকলে তা পড়ুন। নিজকে নিজে বলুন এমন দিন, এমন মূহুর্ত হয়ত জীবনে আর নাও আসতে পারে। আজকের দিনেও যদি গোনাহ্ মাফ না হয়, তবে আর কবে হবে? নিজের বিগত জীবনের সমস্ত গোনাহ্ মাফ করিয়ে পাক সাফ হতে হবে। চোখের পানি দিয়ে পাপ-তাপ ধুয়ে মুছে পবিত্র হতে হবে। যেমন করে হোক, যেভাবেই হোক আল্লাহ্পাকের নিকট থেকে এই সময়ে নিজের সমস্ত গোনাহ্ মাফ করিয়ে নিতে হবে। দোয়ার শেষে নামাজে আমরা যে দরুদ শরীফ পড়ি তা পড়ুন।
আপনার জন্য একটা বিশেষ পরামর্শ। আপনি যে তাবুতে আছেন, যদি কোন কারনে ঐ তাবুর পরিবেশ ভাল না হয়, তবে পাশ্ববর্তী অন্য তাবুতে অথবা কোন গাছের ছায়ায় বা খোলা আকাশের নীচে (সম্ভব হলে দাঁড়িয়ে) অত্যন্ত একাগ্রচিত্তে ভয় ও ভক্তির সাথে দোয়ায়/এবাদতে মশগুল থাকুন। মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যাপার। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু সাথে থাকলে কান্নাকাটি করতে অনেক সময় অসুবিধা হয়। আরাফাতের প্রতিটি মূহুর্তই অত্যন্ত মূল্যবান। এই বিশ্বাস রাখুন যে, লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে আপনার দোয়াও কবুল হবে, ইনশাআল্লাহ্। এটা দোয়া কবুলের স্থান ও সময়।
যদি সাথে কোন মহিলা থাকেন, তবে তিন চারটি বড় চাদর এবং কিছু সেফটিপিন সাথে রাখুন যেন আরাফার তাবুর মধ্যেই চাদর দিয়ে পর্দা করতে পারেন।
৯ জিলহজ্জ সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দানে বা রাস্তায় কোথাও মাগরিবের নামাজ না পড়ে সোজা মুযদালিফা-র দিকে যাত্রা করুন। কাউকে কোন ধরনের কষ্ট না দিয়ে অত্যন্ত শান্ত ও এত্মিনানের সাথে আল্লাহর যিকিরে মশগুল থেকে পথ চলুন। ভাড়ার গাড়ীতে ৩০/৪০ রিয়ালে বা মুয়াল্লিমের গাড়ীতে আরাফা থেকে মুযদালিফায় যাওয়া সুবিধাজনক। তবে সূর্যাস্তের প্রায় দেড়-দুঘন্টা পরে গাড়ী চলাচল শুরু হয়।
এখানে মনে রাখবেন যে আরাফার সীমানা শেষ হলেই মুয্দালিফা শুরু হয় না। আরাফা থেকে প্রায় ৬ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করার পর আসে মুয্দালিফা। মুয্দালিফার পর ‘ওয়াদি আল-মুহাস্সর’। আরাফা থেকে যেতে দু’পাশে সামনাসামনি দুটি পাহাড় পড়বে। এই পাহাড়দ্বয় থেকে ওয়াদি আল মুহাস্সর পর্যন্ত মুযদালিফা। মুযদালিফার শুরু ও শেষ নির্দেশকারী বোর্ড রয়েছে।
মুযদালিফায় পৌঁছে প্রথম কাজ হলো এশার ওয়াক্তে এক আযান এবং দুই একামত দ্বারা পর্যায়ক্রমে মাগরিবের ফরজ পড়ে এশার ফরজ নামাজ আদায় করুন। এই দুই ফরজ নামাজ একসাথে পড়া এখানে ওয়াজিব। ফরজ আদায়ের পর বেতেরের নামাজ ও আদায় করুন। মুয্দালিফায় নামাজ আদায়ের এটাই বিশুদ্ধ পদ্ধতি। খেয়াল রাখতে হবে যে মুযদালিফায় পৌঁছার পর যদি এশার নামাজের সময় না হয় তবে এশার ওযাক্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে এবং প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তাকবীর-ই-তাশরীক পড়ার কথা স্মরন রাখুন।
নামাজ আদায়ের পর আর কোন কাজ নেই। তাই খাওয়া-দাওয়া শেষে বিশ্রাম নিতে পারেন। কেননা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হজ্জের সময় সুব্হে সাদিক পর্যন্ত শুয়ে আরাম করে গেছেন। তবে শক্তি সামর্থ্য থাকলে মুযদালিফার মসজিদে (আল মাশআরুল হারাম) এসে নামাজ পড়তে পারেন এবং মসজিদের বারান্দা বা আশে-পাশে অবস্থান করতে পারেন। আরো সুবিধা আছে। ঐ মসজিদেই ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করার পর সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত অবস্থান করে যিকির আয্কার ও ইবাদতে সময় অতিবাহিত করা বেশ সুবিধাজনক।
আপনি অবশ্যই মনে রাখবেন যে সুবেহ্ সাদিক থেকে সূর্যোদয়ের পূর্ব সময়ের মধ্যে কিছুক্ষন মুযদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। কাজেই মুযদালিফার মসজিদে বা উহার কাছে গিয়েই হোক বা আপনি যেখানে অবস্থান করছেন, সেখানেই হোক ফজরের নামাজ আদায়ের পর হাত উঠিয়ে দোয়ায় মশগুল হবেন ও খুব ফর্সা হওয়া পর্যন্ত দোয়া ও যিকির চালিয়ে যাবেন। আরাফাতে অবস্থানকালে যে দোয়া পড়েছিলেন এখানেও সেই দোয়া পড়তে পারেন। এরপর সূর্যোদয়ের আগেই মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন।
পরামর্শঃ মুযদালিফায় অবস্থানকালে এক ফাঁকে কংকর কুড়িয়ে নিতে পারেন। কেননা মিনায় গিয়ে কংকর খুজে পাওযা রীতিমত কষ্টের ব্যাপার। তবে মুযদালিফা থেকেই কংকর নিতে হবে এ ধারনা ঠিক নয়। মটরশুঁটি আকারের কংকর নেবেন যা আংগুল দিয়ে নিক্ষেপ করা যায়। ৭০(সত্তর)টি কংকর কুঁড়াবেন। কংকর পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে এমন কোন বিধান নেই।
১০ জিলহজ্জঃ ঈদের দিন
হজ্জের তৃতীয় দিন
আজ ১০ জিলহজ্জ। হজ্জের বড় দিন- বছরের সর্বোত্তম দিবস। মিনায় পৌঁছে এই দিনে আপনি হজ্জের চারটি কাজ করবেন। সেগুলো নিম্নরূপঃ
১. জামারায়ে আকাবা বা বড় শয়তানের গায় ৭(সাত)টি কংকর নিক্ষেপ করবেন (ওয়াজিব);
২. কুরবানী করবেন;
৩. মাথা মুন্ডন বা চুল ছোট করবেন ও ইহ্রাম ছেড়ে সাধারন পোশাক পরবেন এবং
৪. কাবা শরীফ তাওয়াফে জিয়ারত করবেন এবং সাফা-মারওয়া সাঈ করবেন এবং জিয়ারত শেষে মিনাতে রাত্রি যাপন করার জন্য ফিরে আসবেন। এটি এদিন না পারলেও তা ১১ বা ১২ তারিখেও করতে পারবেন।
কংকর নিক্ষেপ
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সূর্য ওঠার প্রায় দেড়-দুই ঘন্টাপর কংকর মেরেছিলেন। সে হিসাবে এ সময়টাতেই ১০ তারিখের কংকর নিক্ষেপ করা সুন্নত। সূর্য ঢলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এ সুন্নত সময় চলতে থাকে। তবে সূর্য ঢলে যাওয়া থেকে শুরু করে ১১ তারিখের সুব্হে সাদিকের আগ পর্যন্তও বড় জামরায় কংকর মারা জায়েজ। বর্তমান যুগে বিশ লক্ষাধিক হজ্জ পালনকারীর ভিড়ে সুন্নত আদায় করা অনেকের পক্ষেই কষ্টকর। তাই প্রথমে খবর নিন, কখন ভিড় কম থাকে। অনেক সময় সকাল বেলা ভিড় কম থাকে। কেননা অনেকেই ভাবেন যে, এখন মনে হয় প্রচন্ড ভিড়, তাই পরে যাই। আবার অনেক সময় সকাল বেলায় প্রচন্ড ভিড় থাকে। তাই আপনার উচিৎ হবে, ভিড় আছে কিনা তা খবর নিয়ে দেখা। তবে ১০ জিলহজ্জ সূর্যোদয় থেকে শুরু করে ১১ জিলহজ্জ সুবেহ সাদিক উদয়ের আগ পর্যন্ত ১০ তারিখের কংকর মারা চলে, এটাই আপনি মাথায় রাখুন। তাই এই সময়ের মধ্যে যখন ভিড় কম বলে খবর পাবেন, তখনই কংকর মারতে যাবেন।
নারীদের জন্য বিকেলবেলা ও রাতে কংকর মারা সহজ। কেননা, ঐ সময়ে সাধারনত লোক সমাগম কম থাকে। তবে যারা দূর্বল, অর্থাৎ হাটা-চলায় সামর্থ্য রাখে না, তারা নিজের কংকর অন্যকে দিয়ে মারাতে পারেন। এক্ষেত্রে যিনি প্রতিনিধি হবেন, তাকে অবশ্য হজ্জ পালনকারী হতে হবে এবং নিজের কংকর প্রথমে মেরে পরে অন্যেরটা মারবেন।
এখন কংকর মারার জন্য তালবিয়া পড়ে পড়ে বড় জামরার দিকে অগ্রসর হন। মিনার দিক থেকে তৃতীয় আর মক্কার দিক থেকে প্রথম জামরাকে জামরায়ে আকাবা বা বড় শয়তান বলে। কংকর মারার নিয়ম হচ্ছে, কংকর নিক্ষেপের সময় মিনাকে ডান দিকে এবং কাবাকে বাম দিকে রেখে দাঁড়ান। শাহাদাৎ ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা কংকর ধরে চিহ্ন থেকে অন্তঃত ৫(পাঁচ) হাত দুরে দাঁড়িয়ে স্তম্ভের জায়গায় কংকর নিক্ষেপ করুন। প্রথম কংকর মারার পুব মূহুর্তে তালবিয়া পড়া বন্ধ করে দিন। প্রতিটি কংকর ভিন্ন ভিন্নভাবে মারার সময় বলুনঃ বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর। স্তম্ভের চারপার্শে বৃত্তাকারে সীমা নির্ধারন করে দেয়া জায়গাটির ভিতরেই কংকর পড়তে হবে। যদি কোন কংকর এর ভিতরে না পড়ে কিংবা সজোরে স্তম্ভে লেগে বাইরে ছিটকে পড়ে, আরেকটি কংকর নিক্ষেপ করতে হবে, নতুবা কাফ্রার দিতে হবে।
কুরবানী
বড় জামরায় কংকর মারা শেষ করে হজ্জের শোকরিয়া হিসাবে কুরবানী করা ওয়াজিব। নিজ হাতে করুন কিংবা কাউকে পাঠান; তবে যবেহ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হোন। মিনায় কোরবানী করতে না পারলে মক্কা শহরেও কুরবানী করতে পারেন, জায়েজ আছে। উট-গরু-বকরি-মেষ কোরবানী হিসাবে যবেহ করা যায়। উট হলে ৫ বছর বয়সের, গরু হলে ২ বছর বয়সের ও মেষ হলে ১ বছর বয়সের হতে হবে। উট ও গরু হলে একটাতে ৭জন অংশ নিতে পারবেন। বকরি ও ভেড়ার ক্ষেত্রে একটি পশু একজনের কোরবানী হিসাবে যবেহ করবেন।
মাথা মুন্ডন
পশু কুরবানীর পর মাথা মুন্ডন বা চুল ছোট করুন। তবে মুন্ডন করাই উত্তম। মাথা মুন্ডানো হোক বা চুল ছোট করা হোক সমস্ত মাথা ব্যাপ্ত করা সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সমস্ত মাথা ব্যাপ্ত করে মুন্ডন করেছিলেন। মাথার কিছু অংশ মুন্ডন করা অথবা ছোট করা, আর কিছু অংশ ছেড়ে দেয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর আদর্শের বিপরীত।
আপনার মাথা মুন্ডনের কাজটি মিনায় হওয়া সুন্নত। কেবলামুখী হয়ে বসা এবং ডানদিক থেকে চুল ছাটা ও সুন্নত। মহিলাগন তখনি তাদের চুলের আগা থেকে এক গিরা বা ততোধিক পরিমান কাটবেন, যখন পুরুষেরা কোরবানী করে ফিরে এসে তাদেরকে বলবেন।
মাথা মুন্ডনের পর আপনি হালাল হয়ে গেলেন। এবার ইহ্রাম খুলে নিন। কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্ক এখনও নিষিদ্ধ। তাওয়াফে জিয়ারতের পর জায়েজ।
তাওয়াফে জিয়ারত
১০ জিলহজ্জের চতুর্থ আমল হলো তাওয়াফে জিয়ারত। তাওয়াফে জিয়ারত ১০ তারিখেই সেরে নেয়া ভালো। কিন্তু ১০ তারিখ সম্ভব না হলে ১১ বা ১২ তারিখের সূর্যাস্তের পূর্বে অবশ্যই এ তাওয়াফ করতে হবে। কংকর নিক্ষেপ, কুরবানী করা এবং ক্ষৌরকার্য এ তিনটি আমল শেষ করে গোছল করে, সুগন্ধি মেখে সেলাইযুক্ত কাপড় পড়ে আপনি কাবার দিকে রওয়ানা হবেন। শুরুতে ওমরা আদায়ের সময় যে নিয়মে তাওয়াফ করেছেন, ঠিক সে নিয়মেই তাওয়াফ করবেন। তবে এ তাওয়াফে রামল ও ইযতেবা নেই। এ তাওয়াফটি হলো হজ্জের ফরজ তাওয়াফ। তাওয়াফের পর উমরাহ্ অধ্যায়ে বর্নিত পদ্ধতিতে সাফা-মারওয়ার সাঈ করবেন।
মহিলারা হায়েজ অবস্থায় জিয়ারত করতে পারবেন না। যখন পবিত্র হবেন, তখন তাওয়াফে জিয়ারত করবেন। এজন্য দম দিতে হবে না। তবে যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে মাসিক বন্ধ হওয়ার সময় পর্যন্ত কোনক্রমেই অপেক্ষা করা যাচ্ছে না, ও পরবর্তীতে এসে তাওয়াফে জিয়ারত আদায় করে নেয়ারও সুযোগ নেই, তাহলে ন্যাপকিন দিয়ে ভাল করে বেঁধে তাওয়াফে জিয়ারত সেরে নেয়া বৈধ আছে।
তাওয়াফ এবং সাঈ শেষ করে মিনায় ফিরে আসবেন। ১০ তারিখ দিবাগত রাত ও ১১ তারিখ দিবাগত রাত মিনায় অবস্থান করা ওয়াজিব। আবার ১২ তারিখ যদি মিনায় থাকা অবস্থায় সূর্য ডুবে যায়, তাহলে ১২ তারিখ দিবাগত রাতেও মিনায় থাকা ওয়াজিব হয়ে যায়। ১৩ তারিখ কংকর মেরে তারপর মিনা ত্যাগ করবেন।
১১ জিলহজ্জঃ আইয়ামে তাশরীকের ১ম দিন
হজ্জের চতুর্থ দিন
১১ জিলহজ্জ সূর্য ঢলে যাবার পর তিন জামরায়ে কংকর নিক্ষেপ করবেন। প্রথমে ছোট জামরায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করবেন। কাবা শরীফ বামে ও মিনা ডানে রেখে দাঁড়াবেন। খুশু খুজুর সাথে আল্লাহ্র শিয়ারের-নিদর্শনের যথাযথ তাজিম বুকে নিয়ে একটি একটি করে কংকর নিক্ষেপ করবেন। ‘আল্লাহু আকবর’- বলে প্রতিটি কংকর নিক্ষেপ করবেন। ছোট জামরায় কংকর মারা শেষ হলে একটু সামনে এগিয়ে যাবেন। কেবলামুখী হয়ে দাড়াবেন ও হাত উঠিয়ে দীর্ঘ মোনাজাত করবেন। এরপর মধ্য জামরায় যাবেন। এখানেও ৭টি কংকর একই কায়দায় নিক্ষেপ করবেন। নিক্ষেপের পর সামান্য এগিয়ে কেবলামুখী হয়ে দাড়িয়ে আবার দীর্ঘ মোনাজাত করবেন। এরপর বড় জামরায় কংকর মারতে যাবেন। নিয়মমত এখানেও ৭টি কংকর মারবেন। তবে এবার আর কোন দোয়া করবেন না। কেননা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বড় জামরায় কংকর মারার পর আর দাড়াননি। কংকর মারা শেষ হলে তাবুতে ফিরে যাবেন।
১২ জিলহজ্জঃ আইয়ামে তাশরীকের ২য় দিন
হজ্জের পঞ্চম দিন
ঠিক গতকালের মত দুপুরের পর প্রথমে ছোট, তারপর মধ্যম, তারপর বড় জামরায় ৭টি করে মোট ২১টি কংকর মারবেন। ছোট ও মধ্যম জামরায়ে কংকর মারার পর কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘ মোনাজাত করবেন। আপনি ইচ্ছা করলে এই তারিখে পাথর মেরে সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে পারেন। তাই দেখা যায় অনেকেই ১২ তারিখে মক্কায় ফিরে যান। সেজন্য তাড়াহুড়া করতে গিয়ে দুপুরের আগেই কংকর মেরে ফেলেন; অথচ এটা নাজায়েজ। দুপুরের পরে পুনরায় তাদের কংকর নিক্ষেপ করতে হবে, নতুবা দম দিতে হবে।
১৩ জিলহজ্জঃ আইয়ামে তাশরীকের ৩য় দিন
হজ্জের ৬ষ্ঠ দিন
১২ জিলহজ্জ মিনায় থাকা অবস্থায় সূর্য ডুবে গেলে মিনাতেই রাত কাটাতে হবে এবং ১৩ তারিখ দুপুরের পর পূর্ব বর্নিতভাবে পর্যায়ক্রমে ছোট, মধ্যম ও বড় জামরায় কংকর মেরে মক্কা শরীফে ফিরে আসবেন। মক্কায় পৌছার পর বিদায়ী তাওয়াফ ছাড়া হজ্জের জন্য আর কোন জরুরী কাজ বাকী নাই। আপনি ইচ্ছা করলে ১৪ জিলহজ্জ হতে মসজিদে আয়শা (তানয়ীম) থেকে ইহ্রাম বেঁধে নফল উমরাহ্ করতে পারেন।
মক্কা শরীফ থেকে বিদায়ের পূর্বে বিদায়ী তাওয়াফ করা ওয়াজিব। এতে ইজতেবা, রমল ও সাঈ নেই।
বিদায়ী তাওয়াফের সময় যদি কোন মহিলা হায়েজ অবস্থায় থাকেন এবং তার পাক হওয়া পর্যন্ত মুহরিম ব্যক্তি যদি বিলম্ব করতে অপারগ হন, তাহলে ঐ মহিলার উপর বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব থাকবে না। তার উচিৎ কাবা শরীফে প্রবেশ না করে দরজার নিকট দাড়িয়ে দোয়া চেয়ে রওয়ানা হয়ে যাওয়া।
হজ্জ্ব
মক্কা মুকর্রামাতে দোয়া কবুলের বিশেষ কয়েকটি স্থান
১. মাতাফ- তাওয়াফ করার জায়গা।
২. মুলতাযাম - কা’বা ঘরের দরজা ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থান।
৩. মীযাবে রহমতের নীচে - হাতীমের মধ্যে বায়তুল্লাহ্র ছাদে পানি পড়ার নালীর নীচে।
৪. হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানীর মধ্যবর্তী স্থানে।
৫. মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে।
৬. সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের উপরে বা শীর্ষদেশে।
৭. যমযম কুয়ার কাছে।
৮. জাবালে রহমতে।
৯. জাবালে নূর বা গারে হেরাতে - পাহাড়ের উপরে উঠা জরুরী নয়।
১০. জাবালে সাওর বা গারে সাওরে- পাহাড়ের উপরে উঠা জরুরী নয়।
১১. মাওলিদুন্ নবীতে- অর্থাৎ নবী (সাঃ) এর জন্মস্থানে।
হারাম শরীফের কয়েকটি বিশিষ্ট স্থান
১. মাতাফঃ কাবা ঘরের চারদিকে অবস্থিত তাওয়াফের স্থানকে মাতাফ বা তাওয়াফ চত্তর বলে।
২. হাজরে আসওয়াদঃ কাবা ঘরের পূর্ব-দক্ষিন কোন সিনা বরাবর উঁচুতে দেয়ালের সাথে গেঁথে রাখা কাল পাথর খন্ডকে হাজরে আসওয়াদ বলে। একে চুম্বন করা সুন্নত। কিন্তু বর্তমানে প্রচন্ড ভিড় হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে দূর থেকে হাত দ্বারা ইশারা করলেই চলে। এই হাজরে আস্ওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু হয়।
৩. কাবাঘরঃ কাবা ঘরটি প্রায় বর্গাকৃতি। দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৪৫ ফুট আর প্রস্থ ৪০ ফুট। কাবা শরীফের দরজা ১টি এবং তা কাবা ঘরের পূর্বদিকে অবস্থিত।
৪. মিজাবে রহমতঃ বায়তুল্লাহর উত্তর দিকের ছাদে (হাতীমের মাঝ বরাবর) যে নালা বসানো আছে, তাকে মিজাবে রহমত বলে। এই নালা দিয়ে ছাদের বৃষ্টির পানি পড়ে।
৫. মাকামে ইব্রাহীমঃ কাবা ঘরের দরজা বরাবর ১০/১২ হাত পুবদিকে আয়না ঘেরা ছোট্ট গম্বুজ আকৃতির একটি ঘর আছে। এই ঘরকে ‘মাকামে ইব্রাহীম’ বলে। এ ছোট ঘরে রক্ষিত একখানি পাথরে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পবিত্র পদযুগলের ছাপ অংকিত আছে। পবিত্র কা’বা ঘর নির্মানের সময় হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এ পাথরে দাঁড়িয়ে কাজ করতেন। আল্লাহ্র কুদরতে এ পাথরটি প্রয়োজনমত উপরে এবং নীচে উঠানামা করত। তাওয়াফ শেষে মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত ওয়াজিবুত তাওয়াফ নামাজ পড়তে হয়।
৬. হাতীমঃ কাবা ঘরের উত্তর দিকে অবস্থিত। অর্ধবৃত্তাকারের এক মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর ঘেরা স্থানকে হাতীম বলে। ইহা কাবা ঘরের অংশ বিশেষ। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নবুয়ত লাভের কিছু পূর্বে কুরাইশরা অর্থাভাবের কারনে কা’বা ঘর সংস্কারের সময় এ অংশ ছেড়ে দেয়। এ ছেড়ে দেয়া অংশই হাতীম। তাওয়াফের সময় এর বাইরে দিয়ে তাওয়াফ করতে হয়। ইহাও দোয়া কবুলের স্থান। এখানে নামাজ আদায় করা কাবা ঘরের ভিতের নামাজ আদায় করার সমতূল্য। তবে ফরজ নামাজ এখানে পড়া নিষেধ।
৭. মুলতাজেমঃ হাজরে আসওয়াদ ও কাবাঘরের দরজার মধ্যবর্তী স্থানকে মুলতাজেম বলে। এ জায়গায় বিশেষভাবে দোয়া কবুল হয়। কাউকে কষ্ট না দিয়ে যখনই আপনার সম্ভব হয় তখনই এই মোবারক স্থানটি আঁকড়িয়ে ধরবেন। বুক এবং চেহারা দেয়ালের সাথে লাগাবেন। উভয় হাত উপরে উঠিয়ে দেয়ালে স্থাপন করবেন এবং খুব কাকুতি-মিনতি সহকারে দোয়া করবেন। আরবী দোয়া জানা না থাকলে যে কোন ভাষায় দোয়া করতে পারেন। এইখানে দোয়া কবুলের বিষয়টি বুযুর্গানে দ্বীনেরও পরীক্ষিত।
৮. আবে যমযমঃ এটি পুরাতন একটি কুপ। শিশু হযরত ঈসমাইল (আঃ) ক্ষুধা ও পিপাসায় যখন কাতর হয়ে পড়েন, তখন আল্লাহ্র কুদরতে এ কুপের উদ্ভব হয়। এটি পৃথিবীতে অবস্থিত সকল পানি হতে উত্তম। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) যখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করেন, তখন তিনি শুধুমাত্র যমযমের পানি খেয়ে চল্লিশ দিন কাটিয়েছিলেন। হযরত যাবের থেকে বর্নিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যমযমের পানি যে উদ্দেশ্যে পান করবে, তা সে উদ্দেশ্যেই পুরন হবে। হাদীস শরীফে বর্নিত আছে, যমযমের পানি দ্বারা সকল প্রকার রোগ হতে মুক্তি পাওয়া যায়।
মক্কায় বিশিষ্ট দর্শনীয় স্থানসমূহঃ
১. জাবালে ছওরঃ এটি মক্কা শরীফে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ পাহাড়। এ উচ্চতা পাঁচশত মিটার। এটি মক্কা হতে তিন মাইল দক্ষিনে অবস্থিত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও হযরত আবু বকর (রাঃ) হিযরতের রাতে এ পাহাড়ের একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
২. জাবালে নূর বা গারে হিরাঃ এ পাহাড়টি মক্কা শরীফ থেকে উত্তর দিকে পাঁচ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত। এর উচ্চতা প্রায় দুইশত মিটার। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এ পাহাড়ে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। এ পাহাড়েই জিব্রাইল (আঃ) প্রথম ওহী নিয়ে আগমন করেন।
৩. জান্নাতুল মোয়াল্লাহঃ এটা মক্কা শরীফের উত্তর পূর্বে অবস্থিত। অনেক পুরাতন কবরস্থান এটা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর দাদা আব্দুল মোত্তালেব, চাচা আবু তালেব ও আরো অনেক আত্মীয়ের কবর এখানে অবস্থিত। এই কবরস্থানেই হযরত খাদিজা (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, হযরত আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) এর কবর অবস্থিত।
৪. মসজিদে জিনঃ মসজিদে জিন জান্নাতুল মোযাল্লাহ কবরস্থানের পাশে অবস্থিত। বর্তমানে খুব সুন্দর করে সেখানে একটি মসজিদ তৈরী করা হয়েছে। জিনদের কোরআন শোনার রাতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যে জায়গায় দাগ এঁকেছিলেন, বর্তমানে মসজিদটি সেখানে অবস্থিত।
৫. জাবালে রহমতঃ এই পাহাড়টি আরাফাত ময়দানের মাঝে অবস্থিত। এটিকে ‘আরাফাতের পাহাড় এবং দোয়ার পাহাড়’ ও বলা হয়। এই পাহাড়টির উপরে হযরত আদম (আঃ) এর গোনাহ মাফ হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হজ্জের দিন এই পাহাড়ের বড় পাথরগুলোর পার্শ্বে দাঁড়িয়ে কিবলামুখী হয়ে দু’য়া করেছেন, পাহাড়ের উপর উঠেননি। তাই হজ্জের দিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অনুকরনে জাবালে রহমত এর পার্শ্বে দাড়ানো সুন্নত। আরাফাতের সর্বত্রই অকুফের স্থান।
৬. মাওলিদুন নবীঃ নবী (সাঃ) এর জন্মস্থান।
৭. দারে আরকামঃ ইসলামের প্রথম প্রচারকেন্দ্র। এখানে হযরত ওমর (রাঃ) ইসলাম গ্রহন করেছিলেন।
৮. মসজিদে বেলালঃ ইহা জাবালে আবু কোবায়েসের উপর অবস্থিত।
৯. মসজিদে খালেদ
১০. মসজিদে খায়েফ
১১. মাশয়ারিল হারামঃ মুজদালিফায় অবস্থিত।
১২. উম্মুল মুমিনীন খাদিজা (রাঃ) এর বাড়ী, ফাতিমার জন্মস্থান।
যিয়ারতে মদীনা মোনাওয়ারাহ্
মসজিদে নববী যিয়ারতের সঙ্গে হজ্জের কোন সম্পর্ক না থাকলেও মসজিদে নববী যিয়ারত এবং তাতে নামাজ আদায় বড়ই সওয়াবের কাজ। বড়ই সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি, যে এই মোবারক যিয়ারতে মদীনার তওফীক লাভ করে। কেননা, মসজিদে নববীতে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা, মসজিদে হারাম ছাড়া অন্য যে কোন মসজিদে হাজার ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে এসেছে- তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন স্থানের উদ্দেশ্যে সফর করো না। মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদুল আকসা। সে হিসাবে মদীনা গমনের উদ্দেশ্যে, কবর যিয়ারত হলে তা শুদ্ধ হবে না। নিয়ত করতে হবে মসজিদে নববী জিয়ারতের। তাই মসজিদে নববী যিয়ারতের নিয়ত করে আপনি মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। মদীনায় প্রবেশের সময় সেখানে ইসলামের যে ইতিহাস তৈরী হয়েছে, তা স্মরন করুন। মক্কার মত মদিনাও পবিত্র। তাই মদিনায় গিয়ে যাতে আপনার দ্বারা কোন বেয়াদবি না হয়, কোন গুনাহ্-পাপে লিপ্ত না হন, সেজন্য বেশী বেশী দরুদ শরীফ পড়ুন ও আল্লাহর সাহায্য কামনা করুন।
মদীনায় আপনার হোটেল বা বাসায় গিয়ে মালপত্র রেখে ১৫/২০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে গোছল করুন। অসুবিধা থাকলে ওজু/তায়াম্মুম করুন। তারপর ভাল কাপড় (সাদা হলে ভাল) পরিধান করে আতর-খুশবু ব্যবহার করে মসজিদে নববীর দিকে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে রওয়ানা দিন। মসজিদে নববীতে যাওয়ার জন্য কোন ইহ্রাম-তালবিয়া নেই। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর দরুদ ও সালাত পড়ে পড়ে যেতে হবে এ ব্যাপারেও কোন হাদিস নেই। মদীনার গাছপালার ওপর নজর পড়ামাত্র অথবা সবুজ গম্বুজের উপর দৃষ্টি পড়া মাত্র সালাত ও সালাম পড়তে হবে, এ মর্মেও রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন আদর্শ নেই। যারা এরূপ করতে বলেছেন তারা একান্তই আবেগতাড়িত হয়ে বলেছেন। উপযুক্ত দলীল ব্যতীত আবেগের যথেচ্ছা ব্যবহারের কারনেই ইসলামী শরীয়ত স্বচ্ছতা হারিয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই।
মসজিদে নববীতে পৌঁছে যদি সম্ভব হয় বাবে জিব্রাইল অথবা বাবুস্সালাম দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করুন। অন্যথায় যে কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারেন। মসজিদে প্রবেশের সময় অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে প্রথমে ডান পা রাখুন। আল্লাহ্র নাম স্মরন করুন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি দরুন পাঠ করুন। আল্লাহ যেন আপনার জন্য তার রহমতের সমস্ত দরজা খুলে দেন সেজন্য দোয়া করুন।
বলুন-
بسم الله و الصلاة و السلام على رسول الله – اللهم اغفرلى ذنوبى وافتح لى ابواب رحمتك-
(বিসমিল্লাহি ওস্সালাতু ওস্সালামু আ’লা রাসুলিল্লাহি; আল্লাহুম্মাগফিরলি জুনুবি ওয়াফ্তাহ্লি আব্ওয়াবা রাহমাতিকা)।
অর্থঃ মহান আল্লাহ্র নামে শুরু করছি, দোয়া ও সালাম রাসুল (সাঃ) এর উপর। হে আল্লাহ, আমার পাপসমূহ ক্ষমা কর, আর আমার জন্য তোমার রহমতের দরজা খুলে দাও।
মসজিদে প্রবেশের পর, বসার পূর্বে দুখুলুল মসজিদের দু’রাকাত নামাজ আদায় করুন। হাদীসে এসেছে, তোমাদের মধ্যে যখন কেউ মসজিদে প্রবেশ করে, সে যেন দু’রাকাত নামাজ আদায়ের পূর্বে না বসে’। রওজাতুল জান্নাত মসজিদের মেহরাবের কাছে সাদা ও সবুজ কার্পেট বিছানো জায়গায় নামাজ আদায় করতে পারলে ভালো। কেননা, রওজা শরীফ পবিত্রতম একটি জায়গা, বেহেশতের বাগান হিসাবে হাদীসে যার পরিচয় এসেছে। রওজায় জায়গা না পেলে যে কোন স্থানে দুখুলুল মসজিদ নামাজ আদায় করুন।
এরপর লাইন ধরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পবিত্র রওজার দিকে এগিয়ে যান। রওজা শরীফে পৌঁছে চেহারা মোবারকের বরাবর একটু পিছন দিকে দাঁড়িয়ে যান। জালির একেবারে কাছে যাবেন না এবং একেবারে বেশী দূরেও সরে যাবেন না। কেবলার দিক পিছন করে অত্যন্ত ভক্তি ও আবেগের সাথে দরূদ ও সালাম পেশ করুন। দাঁড়ানোর সুযোগ না পেলে চলমান অবস্থাতেই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি মৃদুস্বরে দরূদ ও সালাম পেশ করুন। বলুনঃ -
السلام عليك ايها النبى و رحمة الله و بركاته-
(আস্সালামু আলাইকা আইউহান নাবিউ ও রাহমাতুল্লাহি ওবারকাতুহু) ।
অর্থঃ হে নবী! আপনার প্রতি অজস্র ধারায় শান্তি বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক
الصلاة و السلام عليك يا رسول الله (আস্সালাতু ওয়া আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলুল্লাহ্ )
অর্থঃ হে আল্লাহর রসুল! আপনার প্রতি অসংখ্য দরূদ ও সালাম।
الصلاة و السلام عليك يا حبيب الله -(আস্সালাতু ওয়া আস্সালামু আলাইকা ইয়া হাবিবাল্লাহ্ )
অর্থঃ হে আল্লাহর হাবীব, আপনার প্রতি অসংখ্য দরূদ ও সালাম।
الصلاة و السلام عليك يا شافع المذنبين (আস্সালাতু ওয়া আস্সালামু আলাইকা ইয়া শফিয়ালমুজনাবিন)
অর্থঃ হে গোনাহগারদের সুপারিশকারী! আপনার প্রতি অজস্র দরূদ ও সালাম।
الصلاة و السلام عليك يا رحمة اللعالمين (আস্সালাতু আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাহ্মাতাল্লিল আ’লামিন)
অর্থঃ হে বিশ্বজাহানের রহমতস্বরূপ! আপনার প্রতি অনেক অনেক দরুদ ও সালাম।
কাজী আবুবকর ইবনে আরবী (রহঃ) বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সম্মান ও আদব তার ওফাতের পরও জীবদ্দশার মত ওয়াজিব। তাই তার পবিত্র কবরের সামনে উচুস্বরে সালাম ও কালাম করা আদবের খেলাফ।
এরপর সামনের দিকে একগজ পরিমান এগিয়ে যান। এখানে হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) এর প্রতি সালাম পেশ করুন। বলুন-
السلام عليك يا ابا بكر (আস্সালামু আলাইকা ইয়া আবাবকর)
অর্থঃ হে আবুবকর (রাঃ)! আপনার প্রতি অসংখ্য সালাম।
السلام عليك يا خليفة رسول الله (আস্সালামু আলাইকা ইয়া খলিফাতা রাসুলিল্লাহি )
অর্থঃ হে রাসুলুল্লাহ্র খলিফা আপনার প্রতি অসংখ্য সালাম।
رضى الله عنك و جزاك عن امة محمد خيرا
(রাদিয়াল্লাহু আনকা ও জাযাকা আন উম্মাতি মুহম্মাদি খাইরান্)
অর্থঃ আল্লাহ আপনার উপর রাজী হউন। উম্মাতে মোহাম্মদীর পক্ষ থেকে আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন।
এরপর আরেকগজ সামনে আগান। এখানে ওমর (রাঃ) এর প্রতি সালাম পেশ করুন। বলুন-
السلام عليك يا عمر (আস্সালামু আলাইকা ইয়া ওমর।)
অর্থঃ হে ওমর! আপনার উপর অজস্র সালাম।
السلام عليك يا امير المومنين (আস্সালামু আলাইকা ইয়া আমিরুল মু’মিনীন)
অর্থঃ হে আমিরুল মোমেনীন! আপনার উপর অজস্র সালাম।
رضى الله عنك و جزاك عن امة محمد خيرا
(রাদিয়াল্লাহু আনকা ও জাযাকা আন উম্মতিম মোহাম্মাদি খাইরান্।)
অর্থঃ আল্লাহ আপনার উপর রাজী হন এবং উম্মতে মোহাম্মাদীর পক্ষ থেকে আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন।
এরপর বাইরে চলে আসুন। কেবলামুখী হয়ে বা কবরের দিকে মুখ করে দোয়া করবেন না। ইমাম মালেক (রাহঃ) বলেন, “কবরের কাছে দোঁয়া করতে দাঁড়ানো আমি শুদ্ধ মনে করি না। তবে সালাম দেবে ও চলে যাবে যেমনটি করতেন ইব্নে ওমর (রাঃ)।”
মহিলাদের জন্য নবী করিম (সাঃ) এর কবর যিয়ারত জায়েয নয়, তাছাড়া অন্য কোন কবরও নয়।
নবীজী বলেছেন- ‘যে সব মহিলা কবর যিয়ারত করবে তাদের উপর আল্লাহ্র অভিশাপ বর্ষিত হয়।‘(তিরমিযী-৩২০)
তাই মহিলারা মসজিদে নববীতে নামাজ পড়তে যাবে এবং নিজ জায়গায় বসেই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে সালাম দিবে। যে কোন জায়গা থেকে সালাম পাঠালেও তা নবী (সাঃ) এর রওজায় পৌঁছিয়ে দেয়া হয়।
পরামর্শঃ রাসুলুল্লাহ (সা) এর পবিত্র কবর হুজরা শরীফের অভ্যন্তরে অবস্থিত। তাই কবরের দেয়াল ছুঁয়ে বরকত নেয়ার জযবা অনেকের মধ্যে থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। আসলে এ ধরনের জযবা-বাসনা থাকাই উচিত নয়। কেননা কবরের চারপাশে তাওয়াফ, কবর ছুঁয়ে বরকত নেওয়া ইত্যাদি শরীয়তে অনুমোদিত নয়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন যে তার কবরকে যেন পূজ্য মূর্তিতে রূপান্তরিত না করা হয়। আর স্পর্শ ও চুম্বন করার বিধান তো কেবল হাজরে আসওয়াদের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কাবার রুকনে ইয়ামানি স্পর্শ করার বিধান রয়েছে। এছাড়া অন্য কোন জায়গা, এমনকি পবিত্র কাবার অন্য কোন অংশ স্পর্শ করে বরকত নেওয়ারও বিধান নেই।
তাছাড়া যিয়ারতের সময় অত্যন্ত সাবধান থাকবেন যে, নবী (সাঃ) এর কাছে কোন সাহায্য চাওয়া যাবে না। রোগমুক্তি বা কোন মকসুদ পুরনের জন্য রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বা মৃত কবরবাসীর কাছে কোন কিছু চাওয়া যায় না। চাইতে হবে শুধু আল্লাহ গাফুরুর রাহীমের কাছে। কবরবাসীদের কাছে চাইলে তা শির্ক হয়ে যাবে। আর শির্ক করলে সব নেক আমল বাতিল হয়ে যাবে। ফলে সে আর মুসলিম থাকবে না।
আপনি যতদিন মদীনায় অবস্থান করবেন, সময় সুযোগ পেলেই এই নিয়মে যিয়ারত করার চেষ্টা করুন।
মসজিদে নববীতে জামাতে নামাজ
মনে রাখবেন, কোন অবস্থাতেই যেন মসজিদে নববীতে আপনার জামাতের নামাজ ছুটে না যায়। মসজিদে নববীতে এক ওয়াক্ত নামাজের সওয়াব মুসলিম ও বোখারী শরীফের বর্ননা অনুযায়ী এক হাজার অপেক্ষাও বেশী। ইবনে মাজাহ্ শরীফের এক রেওয়ায়েতে পঞ্চাশ হাজার নামাজের সমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন- ‘যে ব্যক্তি আমার মসজিদে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে এবং একটি নামাজও বাদ দিবে না, তার জন্য দোযখ থেকে মুক্তি ছাড়পত্র লিখে দেওয়া হবে’। এজন্য মসজিদে নববীতে জামাতে নামাজ পড়ার বিশেষ চেষ্টা করতে হবে।
মসজিদে নববীর ভিতরের গুরুত্বপূর্ন জায়গাসমূহ
আছহাবে ছুফফা চত্বর
বাবে জিব্রাইল দিয়ে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলে ডান দিকে হলো আসহাবে সুফফার চত্তর- যেখানে এমন তিন-চারশত সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন সময়ে তাশরীফ রাখতেন, যারা এলেম শিখা ও ইসলাম প্রচারে নিজেদেরকে ওয়াক্ফ করে দিয়েছিলেন। তাদের অন্যতম হলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত আবু জর গিফারী ও হযরত বেলাল হাবসী (রাঃ)।
সুফফার সামনের দেয়ালে একটি মেহ্রাব তৈরী আছে। এতে ‘মেহরাবে তাহাজ্জুদ’ লেখা আছে। এখানে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন।
রিয়াদুল জান্নাত
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ‘আমার ঘর ও আমার মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের বাগান সমূহ থেকে একটি বাগান’।– (মুসলিম)। তাই মসজিদে নববীর পুরোটাই খায়র ও বরকতের খাজানা হওয়া সত্বেও এই খাস অংশটুকু বিশেষ বরকতময়।এই অংশের সীমা নির্ধারনের জন্য সাদা স্তম্ভ তৈরী হয়েছে এবং তাতে সবুজ নক্শা করা গালিচা বিছিয়ে রাখা হয়েছে। এই মুবারক অংশে সাতটি স্তম্ভ বিশেষ বিষয়ে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও প্রসিদ্ধ। এখানে নফল আদায়কারীদের খুবই ভিড় হয়।
উস্তোয়ানা (স্তম্ভ)
১. উস্তওয়ানা হান্নানাঃ মিম্বারে নববীর ডানপার্শ্বে অবস্থিত খেজুর বৃক্ষের গুড়ির স্থানে নির্মিত স্তম্ভটি। যে গুড়িটি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর মিম্বার স্থানান্তরের সময় উচ্চঃস্বরে ক্রন্দন করেছিল।
২. উস্তওয়ানা ছারীরঃ এখানে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এতেকাফ করতেন এবং রাতে আরামের জন্য তার বিছানা এখানে স্থাপন করতেন। এ স্তম্ভটি হুজরা শরীফের পশ্চিম পার্শ্বে জালি মোবারকের সাথে রয়েছে।
৩. উস্তওয়ানা উফুদঃ বাহির থেকে আগত প্রতিনিধিদল এখানে বসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর হাতে ইসলাম গ্রহন করতেন এবং তাদের সাথে এখানেই বসে কথা বলতেন। এ স্তম্ভটি জালি মোবারকের সাথে রয়েছে।
৪. উস্তওয়ানা হার্ছঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন হুজরা শরীফে তাশরীফ নিয়ে যেতেন, তখন কোন না কোন সাহাবী পাহারার জন্য এখানে বসতেন। এ স্তম্ভটিও জালি মোবারক ঘেঁষে রয়েছে।
৫. উস্তওয়ানা আয়েশা (রাঃ): রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আমার মসজিদে এমন একটি জায়গা রয়েছে, লোকজন যদি সেখানে নামাজ পড়ার ফজিলত জানত, তবে সেখানে স্থান পাওয়ার জন্য লটারীর প্রয়োজন দেখা দিত। স্থানটি চিহ্নিত করার জন্য সাহাবায়ে কেরাম চেষ্টা করতেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর হযরত আয়েশা (রাঃ) তার ভাগ্নে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর (রাঃ) কে সেই জায়গাটি চিনিয়ে দেন। এটিই সেই মঞ্চ। এই স্তম্ভটি উস্তওয়ানা উফুদের পশ্চিম পার্শ্বে রওজায়ে জান্নাতের ভিতর অবস্থিত।
৬. উস্তওয়ানা আবু লুবাবা (রাঃ): হযরত আবু লুবাবা (রাঃ) থেকে একটি ভুল সংঘটিত হবার পর তিনি নিজেকে এই স্তম্ভের সাথে বেঁধে বলেছিলেন, যতক্ষন পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজে না খুলে দেবেন, ততক্ষন পর্যন্ত আমি এর সাথে বাঁধা থাকবো। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও বলেছিলেন, যতক্ষন পর্যন্ত আমাকে আল্লাহতায়ালা আদেশ না করবেন, ততক্ষন পর্যন্ত খুলবো না। এভাবে দীর্ঘ ৫০ দিন পর হযরত আবু লুবাবা (রাঃ) এর তওবা কবুল হলো। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজ হাতে তার বাঁধন খুলে দিলেন। এটা উস্তওয়ানা উফুদের পশ্চিম পার্শ্বে রওজায়ে জান্নাতের ভিতর অবস্থিত।
৭. উস্তওয়ানা জিব্রাঈল (আঃ): হযরত জীব্রাইল (আঃ) যখনই হযরত দেহইয়া কালবী (রাঃ) এর আকৃতি ধারন করে ওহী নিয়ে আসতেন, তখন অধিকাংশ সময় তাকে এখানেই উপবিষ্ট দেখা যেত।
মদীনার যিয়ারতের অন্যান্য স্থানসমূহ
জান্নাতুল বাকী
জান্নাতুল বাকী- আরবীতে বাকিউল গারকাদ- পবিত্র মদিনার একটি কবরস্থান। যেখানে, ইমাম মালিক (রহঃ) এর কথা মতে, প্রায় ১০ হাজার সাহাবা চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন। সেজন্য আমাদের পুরুষদের জন্য সুন্নাত হলো ‘জান্নাতুল বাকী’ কবরস্থান জিয়ারত করা। সেখানে শায়িত আছেন উসমান (রাঃ) সহ অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম। হামযা (রাঃ)সহ উহুদ যুদ্ধের শহীদগন ওহুদ প্রান্তে শায়িত আছেন। যিয়ারতের সময় তাদের সকলের জন্য দোয়া করবেন।
জান্নাতুল বাকীতে সমাহিত মুমিনগনের প্রতি সালাম দেয়ার সুন্নাত তরিকা হলো অনির্দিষ্টভাবে সবাইকে একসাথে সালাম দেয়া ও তাদের জন্য দোয়া করা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আহলে বাকীর যিয়ারতকালে বলতেন-
السلام عليكم اهل الديارمن المومنين و المسلمين- و انا ان شاء الله بكم لاحقون- يرحم الله المستقدمين منا و المستاخرين - نسال الله لنا و لكم العافية-
(আস্সালামু আলাইকুম আহ্লাদ দিয়ারি মিনাল মুমিনিনা ওয়াল মুছ্লিমিন।ওয়া ইন্না ইন্শাল্লাহু বিকুম লাহিকুন। ইয়ার হামুল্লাহুল মুস্তাকদিমিনা মিন্না ওয়াল মুসতা’ খিরিন - নাসআলুল্লাহা লানা ওলাকুমুল আফিয়াহ্।)
অর্থঃ হে মুমিন ও মুসলিম কবরবাসীগন! তোমাদের প্রতি ছালাম। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় অচিরেই আমরা তোমাদের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের পুর্ববর্তী এবং পরবর্তীদের উপর রহমত বর্ষন করুন। আমরা আল্লার নিকট আমাদের ও তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি।
মসজিদে কুবা
‘মসজিদে কুবা’ মুসলমানদের সর্বপ্রথম মসজিদ। হুজুর আকরাম (সাঃ) যখন মক্কা মোকাররমা থেকে হিজরত করে মদীনা মোনাওয়ারায় তাশরীফ আনেন, তখন বনি আউফ গোত্রে অবতরন করেন এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামদেরকে নিয়ে নিজ মোবারক হাতে এই মসজিদের বুনিয়াদ রাখেন। এই মসজিদ মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসার পর গোটা দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মসজিদ।
মদীনা শরীফে গমনকারীদের জন্য মুস্তাহাব হলো এই ‘মসজিদে কুবা’ যিয়ারত করা এবং সেখানে নামাজ আদায় করা। কেননা নবী মোহাম্মদ (সাঃ) কোন কিছুতে আরোহন করে বা পায়ে হেঁটে যখনই এখানে আসতেন, তখন তিনি এখানে দু’রাকাত নামাজ আদায় করতেন। (বুখারী ও মুসলিম) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন- মসজিদে কুবার দু’রাকাত নামাজের সওয়াব একটি ওমরাহ্র সমতূল্য।
মসজিদে কোবায় নামাজ পড়ার নিয়মঃ
মসজিদে কোবায় গিয়ে প্রবেশের সময় ডান পা আগে দেবেন। মসজিদে প্রবেশের দোয়া পড়বেন-
اللهم افتح لى ابواب رحمتك-
(আল্লাহুম্মাফ তাহ্লি আবওয়াবা রাহমাতিকা) - অর্থ- হে আল্লাহ! তোমার রহমতের দরজা আমার জন্য খুলে দাও।
মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়বেন। এ নামাজের আলাদা কোন নিয়ত নেই। কেবল মনে মনে স্থির করবেন, আমি দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করছি। নামাজ শেষ হলে মসজিদ থেকে বের হবেন। বের হবার সময় দোয়া পড়ে বাম পা আগে বাড়াবেন। এখানে অন্য কোন আমল নেই। মসজিদ থেকে বের হবার দোয়া-
اللهم انى اسءلك من فضلك-
(আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদলিক) অর্থঃ হে আল্লাহ! তোমার পক্ষ থেকে আমি কল্যান কামনার জন্য বের হচ্ছি।
শুহাদায়ে ওহুদের কবর জিয়ারত
মসজিদে নববীর উত্তরে প্রায় ৩ মাইল দূরে ওহুদ পর্বতের পাদদেশে ওহুদ যুদ্ধের ময়দান অবস্থিত। এইখানে ওহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরনকারী প্রায় ৭০জন শহীদ সাহাবায়ে কেরামের কবর আছে। তাদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর চাচা হামজা (রাঃ) অন্যতম। এদের কবর যিয়ারত করা শরীয়তসম্মত। জান্নাতুল বাকী যিয়ারতের সময় যে সামগ্রিক দোয়া পড়তে হয়, সে দোয়া পড়েই এখানে যিয়ারত করবেন। যে কোন দিন শুহাদায়ে ওহুদের যিয়ারত করা যেতে পারে। বৃহস্পতিবার অথবা শুক্রবার নির্দিষ্ট করার বিষয়ে কোন প্রমান নেই।
মসজিদে কিবলাতাইন
এটি মদীনা মোনাওয়ারার উত্তর পশ্চিমে “ওয়াদীয়ে আতীক্বে”-র সন্নিকটে উঁচুতে অবস্থিত। এর একটি দেয়ালে বায়তুল মোকাদ্দাসমুখী মেহরাবের চিহ্ন খচিত আছে; আরেকটি দেয়ালে কা’বামুখী মেহরাব তৈরী আছে। কথিত আছে যে, কেবলা পরিবর্তনের হুকুম নামাজরত অবস্থায় এই মসজিদেই নাজিল হয়েছিল। এ জন্যেই একে মসজিদ কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ বলা হয়।
খন্দকের মসজিদ
খন্দকের যুদ্ধের সময় রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীগন যে সকল স্থানে বসে নামাজ পড়েছিলেন এবং দোয়া করেছিলেন, সেখানে পরবর্তীতে পাঁচটি মসজিদ তৈরী করা হয়। যেমনঃ
ক. মসজিদ ফাতাহঃ এই মসজিদের স্থানে বসে নবী করিম (সাঃ) খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানদের জয়ের জন্য দোয়া করেছিলেন বলে একে মসজিদে ফাতাহ্ বা জয়ের মসজিদ বলা হয়।
খ. মসজিদে সোলায়মান ফারসী (রাঃ)
গ. মসজিদে আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ)
ঘ. মসজিদে ওমর (রাঃ)
ঙ. মসজিদে আলী (রাঃ)
মসজিদ পাঁচটি কাছাকাছি ছোট ছোট পাহাড়ে অবস্থিত। একসাথে এই পাঁচটি মসজিদকে “মসজিদে খামস” বলে।
মসজিদে গামামাহ্
এই মসজিদকে মসজিদে মুসাল্লাও বলা হয়। এটা সেই জায়গা যেখানে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ঈদের নামাজ আদায় করতেন এবং এখানেই “সালাতুল ইস্তেকা”-র নামাজ ও আদায় করেছিলেন।
১. মাতাফ- তাওয়াফ করার জায়গা।
২. মুলতাযাম - কা’বা ঘরের দরজা ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থান।
৩. মীযাবে রহমতের নীচে - হাতীমের মধ্যে বায়তুল্লাহ্র ছাদে পানি পড়ার নালীর নীচে।
৪. হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানীর মধ্যবর্তী স্থানে।
৫. মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে।
৬. সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের উপরে বা শীর্ষদেশে।
৭. যমযম কুয়ার কাছে।
৮. জাবালে রহমতে।
৯. জাবালে নূর বা গারে হেরাতে - পাহাড়ের উপরে উঠা জরুরী নয়।
১০. জাবালে সাওর বা গারে সাওরে- পাহাড়ের উপরে উঠা জরুরী নয়।
১১. মাওলিদুন্ নবীতে- অর্থাৎ নবী (সাঃ) এর জন্মস্থানে।
হারাম শরীফের কয়েকটি বিশিষ্ট স্থান
১. মাতাফঃ কাবা ঘরের চারদিকে অবস্থিত তাওয়াফের স্থানকে মাতাফ বা তাওয়াফ চত্তর বলে।
২. হাজরে আসওয়াদঃ কাবা ঘরের পূর্ব-দক্ষিন কোন সিনা বরাবর উঁচুতে দেয়ালের সাথে গেঁথে রাখা কাল পাথর খন্ডকে হাজরে আসওয়াদ বলে। একে চুম্বন করা সুন্নত। কিন্তু বর্তমানে প্রচন্ড ভিড় হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে দূর থেকে হাত দ্বারা ইশারা করলেই চলে। এই হাজরে আস্ওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু হয়।
৩. কাবাঘরঃ কাবা ঘরটি প্রায় বর্গাকৃতি। দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৪৫ ফুট আর প্রস্থ ৪০ ফুট। কাবা শরীফের দরজা ১টি এবং তা কাবা ঘরের পূর্বদিকে অবস্থিত।
৪. মিজাবে রহমতঃ বায়তুল্লাহর উত্তর দিকের ছাদে (হাতীমের মাঝ বরাবর) যে নালা বসানো আছে, তাকে মিজাবে রহমত বলে। এই নালা দিয়ে ছাদের বৃষ্টির পানি পড়ে।
৫. মাকামে ইব্রাহীমঃ কাবা ঘরের দরজা বরাবর ১০/১২ হাত পুবদিকে আয়না ঘেরা ছোট্ট গম্বুজ আকৃতির একটি ঘর আছে। এই ঘরকে ‘মাকামে ইব্রাহীম’ বলে। এ ছোট ঘরে রক্ষিত একখানি পাথরে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পবিত্র পদযুগলের ছাপ অংকিত আছে। পবিত্র কা’বা ঘর নির্মানের সময় হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এ পাথরে দাঁড়িয়ে কাজ করতেন। আল্লাহ্র কুদরতে এ পাথরটি প্রয়োজনমত উপরে এবং নীচে উঠানামা করত। তাওয়াফ শেষে মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত ওয়াজিবুত তাওয়াফ নামাজ পড়তে হয়।
৬. হাতীমঃ কাবা ঘরের উত্তর দিকে অবস্থিত। অর্ধবৃত্তাকারের এক মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর ঘেরা স্থানকে হাতীম বলে। ইহা কাবা ঘরের অংশ বিশেষ। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নবুয়ত লাভের কিছু পূর্বে কুরাইশরা অর্থাভাবের কারনে কা’বা ঘর সংস্কারের সময় এ অংশ ছেড়ে দেয়। এ ছেড়ে দেয়া অংশই হাতীম। তাওয়াফের সময় এর বাইরে দিয়ে তাওয়াফ করতে হয়। ইহাও দোয়া কবুলের স্থান। এখানে নামাজ আদায় করা কাবা ঘরের ভিতের নামাজ আদায় করার সমতূল্য। তবে ফরজ নামাজ এখানে পড়া নিষেধ।
৭. মুলতাজেমঃ হাজরে আসওয়াদ ও কাবাঘরের দরজার মধ্যবর্তী স্থানকে মুলতাজেম বলে। এ জায়গায় বিশেষভাবে দোয়া কবুল হয়। কাউকে কষ্ট না দিয়ে যখনই আপনার সম্ভব হয় তখনই এই মোবারক স্থানটি আঁকড়িয়ে ধরবেন। বুক এবং চেহারা দেয়ালের সাথে লাগাবেন। উভয় হাত উপরে উঠিয়ে দেয়ালে স্থাপন করবেন এবং খুব কাকুতি-মিনতি সহকারে দোয়া করবেন। আরবী দোয়া জানা না থাকলে যে কোন ভাষায় দোয়া করতে পারেন। এইখানে দোয়া কবুলের বিষয়টি বুযুর্গানে দ্বীনেরও পরীক্ষিত।
৮. আবে যমযমঃ এটি পুরাতন একটি কুপ। শিশু হযরত ঈসমাইল (আঃ) ক্ষুধা ও পিপাসায় যখন কাতর হয়ে পড়েন, তখন আল্লাহ্র কুদরতে এ কুপের উদ্ভব হয়। এটি পৃথিবীতে অবস্থিত সকল পানি হতে উত্তম। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) যখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করেন, তখন তিনি শুধুমাত্র যমযমের পানি খেয়ে চল্লিশ দিন কাটিয়েছিলেন। হযরত যাবের থেকে বর্নিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যমযমের পানি যে উদ্দেশ্যে পান করবে, তা সে উদ্দেশ্যেই পুরন হবে। হাদীস শরীফে বর্নিত আছে, যমযমের পানি দ্বারা সকল প্রকার রোগ হতে মুক্তি পাওয়া যায়।
মক্কায় বিশিষ্ট দর্শনীয় স্থানসমূহঃ
১. জাবালে ছওরঃ এটি মক্কা শরীফে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ পাহাড়। এ উচ্চতা পাঁচশত মিটার। এটি মক্কা হতে তিন মাইল দক্ষিনে অবস্থিত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও হযরত আবু বকর (রাঃ) হিযরতের রাতে এ পাহাড়ের একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
২. জাবালে নূর বা গারে হিরাঃ এ পাহাড়টি মক্কা শরীফ থেকে উত্তর দিকে পাঁচ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত। এর উচ্চতা প্রায় দুইশত মিটার। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এ পাহাড়ে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। এ পাহাড়েই জিব্রাইল (আঃ) প্রথম ওহী নিয়ে আগমন করেন।
৩. জান্নাতুল মোয়াল্লাহঃ এটা মক্কা শরীফের উত্তর পূর্বে অবস্থিত। অনেক পুরাতন কবরস্থান এটা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর দাদা আব্দুল মোত্তালেব, চাচা আবু তালেব ও আরো অনেক আত্মীয়ের কবর এখানে অবস্থিত। এই কবরস্থানেই হযরত খাদিজা (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, হযরত আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) এর কবর অবস্থিত।
৪. মসজিদে জিনঃ মসজিদে জিন জান্নাতুল মোযাল্লাহ কবরস্থানের পাশে অবস্থিত। বর্তমানে খুব সুন্দর করে সেখানে একটি মসজিদ তৈরী করা হয়েছে। জিনদের কোরআন শোনার রাতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যে জায়গায় দাগ এঁকেছিলেন, বর্তমানে মসজিদটি সেখানে অবস্থিত।
৫. জাবালে রহমতঃ এই পাহাড়টি আরাফাত ময়দানের মাঝে অবস্থিত। এটিকে ‘আরাফাতের পাহাড় এবং দোয়ার পাহাড়’ ও বলা হয়। এই পাহাড়টির উপরে হযরত আদম (আঃ) এর গোনাহ মাফ হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হজ্জের দিন এই পাহাড়ের বড় পাথরগুলোর পার্শ্বে দাঁড়িয়ে কিবলামুখী হয়ে দু’য়া করেছেন, পাহাড়ের উপর উঠেননি। তাই হজ্জের দিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অনুকরনে জাবালে রহমত এর পার্শ্বে দাড়ানো সুন্নত। আরাফাতের সর্বত্রই অকুফের স্থান।
৬. মাওলিদুন নবীঃ নবী (সাঃ) এর জন্মস্থান।
৭. দারে আরকামঃ ইসলামের প্রথম প্রচারকেন্দ্র। এখানে হযরত ওমর (রাঃ) ইসলাম গ্রহন করেছিলেন।
৮. মসজিদে বেলালঃ ইহা জাবালে আবু কোবায়েসের উপর অবস্থিত।
৯. মসজিদে খালেদ
১০. মসজিদে খায়েফ
১১. মাশয়ারিল হারামঃ মুজদালিফায় অবস্থিত।
১২. উম্মুল মুমিনীন খাদিজা (রাঃ) এর বাড়ী, ফাতিমার জন্মস্থান।
যিয়ারতে মদীনা মোনাওয়ারাহ্
মসজিদে নববী যিয়ারতের সঙ্গে হজ্জের কোন সম্পর্ক না থাকলেও মসজিদে নববী যিয়ারত এবং তাতে নামাজ আদায় বড়ই সওয়াবের কাজ। বড়ই সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি, যে এই মোবারক যিয়ারতে মদীনার তওফীক লাভ করে। কেননা, মসজিদে নববীতে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা, মসজিদে হারাম ছাড়া অন্য যে কোন মসজিদে হাজার ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে এসেছে- তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন স্থানের উদ্দেশ্যে সফর করো না। মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদুল আকসা। সে হিসাবে মদীনা গমনের উদ্দেশ্যে, কবর যিয়ারত হলে তা শুদ্ধ হবে না। নিয়ত করতে হবে মসজিদে নববী জিয়ারতের। তাই মসজিদে নববী যিয়ারতের নিয়ত করে আপনি মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। মদীনায় প্রবেশের সময় সেখানে ইসলামের যে ইতিহাস তৈরী হয়েছে, তা স্মরন করুন। মক্কার মত মদিনাও পবিত্র। তাই মদিনায় গিয়ে যাতে আপনার দ্বারা কোন বেয়াদবি না হয়, কোন গুনাহ্-পাপে লিপ্ত না হন, সেজন্য বেশী বেশী দরুদ শরীফ পড়ুন ও আল্লাহর সাহায্য কামনা করুন।
মদীনায় আপনার হোটেল বা বাসায় গিয়ে মালপত্র রেখে ১৫/২০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে গোছল করুন। অসুবিধা থাকলে ওজু/তায়াম্মুম করুন। তারপর ভাল কাপড় (সাদা হলে ভাল) পরিধান করে আতর-খুশবু ব্যবহার করে মসজিদে নববীর দিকে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে রওয়ানা দিন। মসজিদে নববীতে যাওয়ার জন্য কোন ইহ্রাম-তালবিয়া নেই। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর দরুদ ও সালাত পড়ে পড়ে যেতে হবে এ ব্যাপারেও কোন হাদিস নেই। মদীনার গাছপালার ওপর নজর পড়ামাত্র অথবা সবুজ গম্বুজের উপর দৃষ্টি পড়া মাত্র সালাত ও সালাম পড়তে হবে, এ মর্মেও রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন আদর্শ নেই। যারা এরূপ করতে বলেছেন তারা একান্তই আবেগতাড়িত হয়ে বলেছেন। উপযুক্ত দলীল ব্যতীত আবেগের যথেচ্ছা ব্যবহারের কারনেই ইসলামী শরীয়ত স্বচ্ছতা হারিয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই।
মসজিদে নববীতে পৌঁছে যদি সম্ভব হয় বাবে জিব্রাইল অথবা বাবুস্সালাম দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করুন। অন্যথায় যে কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারেন। মসজিদে প্রবেশের সময় অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে প্রথমে ডান পা রাখুন। আল্লাহ্র নাম স্মরন করুন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি দরুন পাঠ করুন। আল্লাহ যেন আপনার জন্য তার রহমতের সমস্ত দরজা খুলে দেন সেজন্য দোয়া করুন।
বলুন-
بسم الله و الصلاة و السلام على رسول الله – اللهم اغفرلى ذنوبى وافتح لى ابواب رحمتك-
(বিসমিল্লাহি ওস্সালাতু ওস্সালামু আ’লা রাসুলিল্লাহি; আল্লাহুম্মাগফিরলি জুনুবি ওয়াফ্তাহ্লি আব্ওয়াবা রাহমাতিকা)।
অর্থঃ মহান আল্লাহ্র নামে শুরু করছি, দোয়া ও সালাম রাসুল (সাঃ) এর উপর। হে আল্লাহ, আমার পাপসমূহ ক্ষমা কর, আর আমার জন্য তোমার রহমতের দরজা খুলে দাও।
মসজিদে প্রবেশের পর, বসার পূর্বে দুখুলুল মসজিদের দু’রাকাত নামাজ আদায় করুন। হাদীসে এসেছে, তোমাদের মধ্যে যখন কেউ মসজিদে প্রবেশ করে, সে যেন দু’রাকাত নামাজ আদায়ের পূর্বে না বসে’। রওজাতুল জান্নাত মসজিদের মেহরাবের কাছে সাদা ও সবুজ কার্পেট বিছানো জায়গায় নামাজ আদায় করতে পারলে ভালো। কেননা, রওজা শরীফ পবিত্রতম একটি জায়গা, বেহেশতের বাগান হিসাবে হাদীসে যার পরিচয় এসেছে। রওজায় জায়গা না পেলে যে কোন স্থানে দুখুলুল মসজিদ নামাজ আদায় করুন।
এরপর লাইন ধরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পবিত্র রওজার দিকে এগিয়ে যান। রওজা শরীফে পৌঁছে চেহারা মোবারকের বরাবর একটু পিছন দিকে দাঁড়িয়ে যান। জালির একেবারে কাছে যাবেন না এবং একেবারে বেশী দূরেও সরে যাবেন না। কেবলার দিক পিছন করে অত্যন্ত ভক্তি ও আবেগের সাথে দরূদ ও সালাম পেশ করুন। দাঁড়ানোর সুযোগ না পেলে চলমান অবস্থাতেই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি মৃদুস্বরে দরূদ ও সালাম পেশ করুন। বলুনঃ -
السلام عليك ايها النبى و رحمة الله و بركاته-
(আস্সালামু আলাইকা আইউহান নাবিউ ও রাহমাতুল্লাহি ওবারকাতুহু) ।
অর্থঃ হে নবী! আপনার প্রতি অজস্র ধারায় শান্তি বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক
الصلاة و السلام عليك يا رسول الله (আস্সালাতু ওয়া আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলুল্লাহ্ )
অর্থঃ হে আল্লাহর রসুল! আপনার প্রতি অসংখ্য দরূদ ও সালাম।
الصلاة و السلام عليك يا حبيب الله -(আস্সালাতু ওয়া আস্সালামু আলাইকা ইয়া হাবিবাল্লাহ্ )
অর্থঃ হে আল্লাহর হাবীব, আপনার প্রতি অসংখ্য দরূদ ও সালাম।
الصلاة و السلام عليك يا شافع المذنبين (আস্সালাতু ওয়া আস্সালামু আলাইকা ইয়া শফিয়ালমুজনাবিন)
অর্থঃ হে গোনাহগারদের সুপারিশকারী! আপনার প্রতি অজস্র দরূদ ও সালাম।
الصلاة و السلام عليك يا رحمة اللعالمين (আস্সালাতু আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাহ্মাতাল্লিল আ’লামিন)
অর্থঃ হে বিশ্বজাহানের রহমতস্বরূপ! আপনার প্রতি অনেক অনেক দরুদ ও সালাম।
কাজী আবুবকর ইবনে আরবী (রহঃ) বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সম্মান ও আদব তার ওফাতের পরও জীবদ্দশার মত ওয়াজিব। তাই তার পবিত্র কবরের সামনে উচুস্বরে সালাম ও কালাম করা আদবের খেলাফ।
এরপর সামনের দিকে একগজ পরিমান এগিয়ে যান। এখানে হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) এর প্রতি সালাম পেশ করুন। বলুন-
السلام عليك يا ابا بكر (আস্সালামু আলাইকা ইয়া আবাবকর)
অর্থঃ হে আবুবকর (রাঃ)! আপনার প্রতি অসংখ্য সালাম।
السلام عليك يا خليفة رسول الله (আস্সালামু আলাইকা ইয়া খলিফাতা রাসুলিল্লাহি )
অর্থঃ হে রাসুলুল্লাহ্র খলিফা আপনার প্রতি অসংখ্য সালাম।
رضى الله عنك و جزاك عن امة محمد خيرا
(রাদিয়াল্লাহু আনকা ও জাযাকা আন উম্মাতি মুহম্মাদি খাইরান্)
অর্থঃ আল্লাহ আপনার উপর রাজী হউন। উম্মাতে মোহাম্মদীর পক্ষ থেকে আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন।
এরপর আরেকগজ সামনে আগান। এখানে ওমর (রাঃ) এর প্রতি সালাম পেশ করুন। বলুন-
السلام عليك يا عمر (আস্সালামু আলাইকা ইয়া ওমর।)
অর্থঃ হে ওমর! আপনার উপর অজস্র সালাম।
السلام عليك يا امير المومنين (আস্সালামু আলাইকা ইয়া আমিরুল মু’মিনীন)
অর্থঃ হে আমিরুল মোমেনীন! আপনার উপর অজস্র সালাম।
رضى الله عنك و جزاك عن امة محمد خيرا
(রাদিয়াল্লাহু আনকা ও জাযাকা আন উম্মতিম মোহাম্মাদি খাইরান্।)
অর্থঃ আল্লাহ আপনার উপর রাজী হন এবং উম্মতে মোহাম্মাদীর পক্ষ থেকে আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন।
এরপর বাইরে চলে আসুন। কেবলামুখী হয়ে বা কবরের দিকে মুখ করে দোয়া করবেন না। ইমাম মালেক (রাহঃ) বলেন, “কবরের কাছে দোঁয়া করতে দাঁড়ানো আমি শুদ্ধ মনে করি না। তবে সালাম দেবে ও চলে যাবে যেমনটি করতেন ইব্নে ওমর (রাঃ)।”
মহিলাদের জন্য নবী করিম (সাঃ) এর কবর যিয়ারত জায়েয নয়, তাছাড়া অন্য কোন কবরও নয়।
নবীজী বলেছেন- ‘যে সব মহিলা কবর যিয়ারত করবে তাদের উপর আল্লাহ্র অভিশাপ বর্ষিত হয়।‘(তিরমিযী-৩২০)
তাই মহিলারা মসজিদে নববীতে নামাজ পড়তে যাবে এবং নিজ জায়গায় বসেই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে সালাম দিবে। যে কোন জায়গা থেকে সালাম পাঠালেও তা নবী (সাঃ) এর রওজায় পৌঁছিয়ে দেয়া হয়।
পরামর্শঃ রাসুলুল্লাহ (সা) এর পবিত্র কবর হুজরা শরীফের অভ্যন্তরে অবস্থিত। তাই কবরের দেয়াল ছুঁয়ে বরকত নেয়ার জযবা অনেকের মধ্যে থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। আসলে এ ধরনের জযবা-বাসনা থাকাই উচিত নয়। কেননা কবরের চারপাশে তাওয়াফ, কবর ছুঁয়ে বরকত নেওয়া ইত্যাদি শরীয়তে অনুমোদিত নয়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন যে তার কবরকে যেন পূজ্য মূর্তিতে রূপান্তরিত না করা হয়। আর স্পর্শ ও চুম্বন করার বিধান তো কেবল হাজরে আসওয়াদের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কাবার রুকনে ইয়ামানি স্পর্শ করার বিধান রয়েছে। এছাড়া অন্য কোন জায়গা, এমনকি পবিত্র কাবার অন্য কোন অংশ স্পর্শ করে বরকত নেওয়ারও বিধান নেই।
তাছাড়া যিয়ারতের সময় অত্যন্ত সাবধান থাকবেন যে, নবী (সাঃ) এর কাছে কোন সাহায্য চাওয়া যাবে না। রোগমুক্তি বা কোন মকসুদ পুরনের জন্য রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বা মৃত কবরবাসীর কাছে কোন কিছু চাওয়া যায় না। চাইতে হবে শুধু আল্লাহ গাফুরুর রাহীমের কাছে। কবরবাসীদের কাছে চাইলে তা শির্ক হয়ে যাবে। আর শির্ক করলে সব নেক আমল বাতিল হয়ে যাবে। ফলে সে আর মুসলিম থাকবে না।
আপনি যতদিন মদীনায় অবস্থান করবেন, সময় সুযোগ পেলেই এই নিয়মে যিয়ারত করার চেষ্টা করুন।
মসজিদে নববীতে জামাতে নামাজ
মনে রাখবেন, কোন অবস্থাতেই যেন মসজিদে নববীতে আপনার জামাতের নামাজ ছুটে না যায়। মসজিদে নববীতে এক ওয়াক্ত নামাজের সওয়াব মুসলিম ও বোখারী শরীফের বর্ননা অনুযায়ী এক হাজার অপেক্ষাও বেশী। ইবনে মাজাহ্ শরীফের এক রেওয়ায়েতে পঞ্চাশ হাজার নামাজের সমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন- ‘যে ব্যক্তি আমার মসজিদে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে এবং একটি নামাজও বাদ দিবে না, তার জন্য দোযখ থেকে মুক্তি ছাড়পত্র লিখে দেওয়া হবে’। এজন্য মসজিদে নববীতে জামাতে নামাজ পড়ার বিশেষ চেষ্টা করতে হবে।
মসজিদে নববীর ভিতরের গুরুত্বপূর্ন জায়গাসমূহ
আছহাবে ছুফফা চত্বর
বাবে জিব্রাইল দিয়ে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলে ডান দিকে হলো আসহাবে সুফফার চত্তর- যেখানে এমন তিন-চারশত সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন সময়ে তাশরীফ রাখতেন, যারা এলেম শিখা ও ইসলাম প্রচারে নিজেদেরকে ওয়াক্ফ করে দিয়েছিলেন। তাদের অন্যতম হলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত আবু জর গিফারী ও হযরত বেলাল হাবসী (রাঃ)।
সুফফার সামনের দেয়ালে একটি মেহ্রাব তৈরী আছে। এতে ‘মেহরাবে তাহাজ্জুদ’ লেখা আছে। এখানে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন।
রিয়াদুল জান্নাত
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ‘আমার ঘর ও আমার মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের বাগান সমূহ থেকে একটি বাগান’।– (মুসলিম)। তাই মসজিদে নববীর পুরোটাই খায়র ও বরকতের খাজানা হওয়া সত্বেও এই খাস অংশটুকু বিশেষ বরকতময়।এই অংশের সীমা নির্ধারনের জন্য সাদা স্তম্ভ তৈরী হয়েছে এবং তাতে সবুজ নক্শা করা গালিচা বিছিয়ে রাখা হয়েছে। এই মুবারক অংশে সাতটি স্তম্ভ বিশেষ বিষয়ে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও প্রসিদ্ধ। এখানে নফল আদায়কারীদের খুবই ভিড় হয়।
উস্তোয়ানা (স্তম্ভ)
১. উস্তওয়ানা হান্নানাঃ মিম্বারে নববীর ডানপার্শ্বে অবস্থিত খেজুর বৃক্ষের গুড়ির স্থানে নির্মিত স্তম্ভটি। যে গুড়িটি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর মিম্বার স্থানান্তরের সময় উচ্চঃস্বরে ক্রন্দন করেছিল।
২. উস্তওয়ানা ছারীরঃ এখানে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এতেকাফ করতেন এবং রাতে আরামের জন্য তার বিছানা এখানে স্থাপন করতেন। এ স্তম্ভটি হুজরা শরীফের পশ্চিম পার্শ্বে জালি মোবারকের সাথে রয়েছে।
৩. উস্তওয়ানা উফুদঃ বাহির থেকে আগত প্রতিনিধিদল এখানে বসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর হাতে ইসলাম গ্রহন করতেন এবং তাদের সাথে এখানেই বসে কথা বলতেন। এ স্তম্ভটি জালি মোবারকের সাথে রয়েছে।
৪. উস্তওয়ানা হার্ছঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন হুজরা শরীফে তাশরীফ নিয়ে যেতেন, তখন কোন না কোন সাহাবী পাহারার জন্য এখানে বসতেন। এ স্তম্ভটিও জালি মোবারক ঘেঁষে রয়েছে।
৫. উস্তওয়ানা আয়েশা (রাঃ): রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আমার মসজিদে এমন একটি জায়গা রয়েছে, লোকজন যদি সেখানে নামাজ পড়ার ফজিলত জানত, তবে সেখানে স্থান পাওয়ার জন্য লটারীর প্রয়োজন দেখা দিত। স্থানটি চিহ্নিত করার জন্য সাহাবায়ে কেরাম চেষ্টা করতেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর হযরত আয়েশা (রাঃ) তার ভাগ্নে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর (রাঃ) কে সেই জায়গাটি চিনিয়ে দেন। এটিই সেই মঞ্চ। এই স্তম্ভটি উস্তওয়ানা উফুদের পশ্চিম পার্শ্বে রওজায়ে জান্নাতের ভিতর অবস্থিত।
৬. উস্তওয়ানা আবু লুবাবা (রাঃ): হযরত আবু লুবাবা (রাঃ) থেকে একটি ভুল সংঘটিত হবার পর তিনি নিজেকে এই স্তম্ভের সাথে বেঁধে বলেছিলেন, যতক্ষন পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজে না খুলে দেবেন, ততক্ষন পর্যন্ত আমি এর সাথে বাঁধা থাকবো। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও বলেছিলেন, যতক্ষন পর্যন্ত আমাকে আল্লাহতায়ালা আদেশ না করবেন, ততক্ষন পর্যন্ত খুলবো না। এভাবে দীর্ঘ ৫০ দিন পর হযরত আবু লুবাবা (রাঃ) এর তওবা কবুল হলো। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজ হাতে তার বাঁধন খুলে দিলেন। এটা উস্তওয়ানা উফুদের পশ্চিম পার্শ্বে রওজায়ে জান্নাতের ভিতর অবস্থিত।
৭. উস্তওয়ানা জিব্রাঈল (আঃ): হযরত জীব্রাইল (আঃ) যখনই হযরত দেহইয়া কালবী (রাঃ) এর আকৃতি ধারন করে ওহী নিয়ে আসতেন, তখন অধিকাংশ সময় তাকে এখানেই উপবিষ্ট দেখা যেত।
মদীনার যিয়ারতের অন্যান্য স্থানসমূহ
জান্নাতুল বাকী
জান্নাতুল বাকী- আরবীতে বাকিউল গারকাদ- পবিত্র মদিনার একটি কবরস্থান। যেখানে, ইমাম মালিক (রহঃ) এর কথা মতে, প্রায় ১০ হাজার সাহাবা চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন। সেজন্য আমাদের পুরুষদের জন্য সুন্নাত হলো ‘জান্নাতুল বাকী’ কবরস্থান জিয়ারত করা। সেখানে শায়িত আছেন উসমান (রাঃ) সহ অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম। হামযা (রাঃ)সহ উহুদ যুদ্ধের শহীদগন ওহুদ প্রান্তে শায়িত আছেন। যিয়ারতের সময় তাদের সকলের জন্য দোয়া করবেন।
জান্নাতুল বাকীতে সমাহিত মুমিনগনের প্রতি সালাম দেয়ার সুন্নাত তরিকা হলো অনির্দিষ্টভাবে সবাইকে একসাথে সালাম দেয়া ও তাদের জন্য দোয়া করা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আহলে বাকীর যিয়ারতকালে বলতেন-
السلام عليكم اهل الديارمن المومنين و المسلمين- و انا ان شاء الله بكم لاحقون- يرحم الله المستقدمين منا و المستاخرين - نسال الله لنا و لكم العافية-
(আস্সালামু আলাইকুম আহ্লাদ দিয়ারি মিনাল মুমিনিনা ওয়াল মুছ্লিমিন।ওয়া ইন্না ইন্শাল্লাহু বিকুম লাহিকুন। ইয়ার হামুল্লাহুল মুস্তাকদিমিনা মিন্না ওয়াল মুসতা’ খিরিন - নাসআলুল্লাহা লানা ওলাকুমুল আফিয়াহ্।)
অর্থঃ হে মুমিন ও মুসলিম কবরবাসীগন! তোমাদের প্রতি ছালাম। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় অচিরেই আমরা তোমাদের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের পুর্ববর্তী এবং পরবর্তীদের উপর রহমত বর্ষন করুন। আমরা আল্লার নিকট আমাদের ও তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি।
মসজিদে কুবা
‘মসজিদে কুবা’ মুসলমানদের সর্বপ্রথম মসজিদ। হুজুর আকরাম (সাঃ) যখন মক্কা মোকাররমা থেকে হিজরত করে মদীনা মোনাওয়ারায় তাশরীফ আনেন, তখন বনি আউফ গোত্রে অবতরন করেন এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামদেরকে নিয়ে নিজ মোবারক হাতে এই মসজিদের বুনিয়াদ রাখেন। এই মসজিদ মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসার পর গোটা দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মসজিদ।
মদীনা শরীফে গমনকারীদের জন্য মুস্তাহাব হলো এই ‘মসজিদে কুবা’ যিয়ারত করা এবং সেখানে নামাজ আদায় করা। কেননা নবী মোহাম্মদ (সাঃ) কোন কিছুতে আরোহন করে বা পায়ে হেঁটে যখনই এখানে আসতেন, তখন তিনি এখানে দু’রাকাত নামাজ আদায় করতেন। (বুখারী ও মুসলিম) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন- মসজিদে কুবার দু’রাকাত নামাজের সওয়াব একটি ওমরাহ্র সমতূল্য।
মসজিদে কোবায় নামাজ পড়ার নিয়মঃ
মসজিদে কোবায় গিয়ে প্রবেশের সময় ডান পা আগে দেবেন। মসজিদে প্রবেশের দোয়া পড়বেন-
اللهم افتح لى ابواب رحمتك-
(আল্লাহুম্মাফ তাহ্লি আবওয়াবা রাহমাতিকা) - অর্থ- হে আল্লাহ! তোমার রহমতের দরজা আমার জন্য খুলে দাও।
মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়বেন। এ নামাজের আলাদা কোন নিয়ত নেই। কেবল মনে মনে স্থির করবেন, আমি দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করছি। নামাজ শেষ হলে মসজিদ থেকে বের হবেন। বের হবার সময় দোয়া পড়ে বাম পা আগে বাড়াবেন। এখানে অন্য কোন আমল নেই। মসজিদ থেকে বের হবার দোয়া-
اللهم انى اسءلك من فضلك-
(আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদলিক) অর্থঃ হে আল্লাহ! তোমার পক্ষ থেকে আমি কল্যান কামনার জন্য বের হচ্ছি।
শুহাদায়ে ওহুদের কবর জিয়ারত
মসজিদে নববীর উত্তরে প্রায় ৩ মাইল দূরে ওহুদ পর্বতের পাদদেশে ওহুদ যুদ্ধের ময়দান অবস্থিত। এইখানে ওহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরনকারী প্রায় ৭০জন শহীদ সাহাবায়ে কেরামের কবর আছে। তাদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর চাচা হামজা (রাঃ) অন্যতম। এদের কবর যিয়ারত করা শরীয়তসম্মত। জান্নাতুল বাকী যিয়ারতের সময় যে সামগ্রিক দোয়া পড়তে হয়, সে দোয়া পড়েই এখানে যিয়ারত করবেন। যে কোন দিন শুহাদায়ে ওহুদের যিয়ারত করা যেতে পারে। বৃহস্পতিবার অথবা শুক্রবার নির্দিষ্ট করার বিষয়ে কোন প্রমান নেই।
মসজিদে কিবলাতাইন
এটি মদীনা মোনাওয়ারার উত্তর পশ্চিমে “ওয়াদীয়ে আতীক্বে”-র সন্নিকটে উঁচুতে অবস্থিত। এর একটি দেয়ালে বায়তুল মোকাদ্দাসমুখী মেহরাবের চিহ্ন খচিত আছে; আরেকটি দেয়ালে কা’বামুখী মেহরাব তৈরী আছে। কথিত আছে যে, কেবলা পরিবর্তনের হুকুম নামাজরত অবস্থায় এই মসজিদেই নাজিল হয়েছিল। এ জন্যেই একে মসজিদ কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ বলা হয়।
খন্দকের মসজিদ
খন্দকের যুদ্ধের সময় রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীগন যে সকল স্থানে বসে নামাজ পড়েছিলেন এবং দোয়া করেছিলেন, সেখানে পরবর্তীতে পাঁচটি মসজিদ তৈরী করা হয়। যেমনঃ
ক. মসজিদ ফাতাহঃ এই মসজিদের স্থানে বসে নবী করিম (সাঃ) খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানদের জয়ের জন্য দোয়া করেছিলেন বলে একে মসজিদে ফাতাহ্ বা জয়ের মসজিদ বলা হয়।
খ. মসজিদে সোলায়মান ফারসী (রাঃ)
গ. মসজিদে আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ)
ঘ. মসজিদে ওমর (রাঃ)
ঙ. মসজিদে আলী (রাঃ)
মসজিদ পাঁচটি কাছাকাছি ছোট ছোট পাহাড়ে অবস্থিত। একসাথে এই পাঁচটি মসজিদকে “মসজিদে খামস” বলে।
মসজিদে গামামাহ্
এই মসজিদকে মসজিদে মুসাল্লাও বলা হয়। এটা সেই জায়গা যেখানে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ঈদের নামাজ আদায় করতেন এবং এখানেই “সালাতুল ইস্তেকা”-র নামাজ ও আদায় করেছিলেন।
Subscribe to:
Posts (Atom)