উম্রার তৃতীয় কাজঃ সা’ঈ করা (ওয়াজিব)
তাওয়াফ শেষে যমযম পানি পান করার পর ‘হাজরে আসওয়াদ’ এ সম্ভব হলে চুমু দিয়ে বা হাতে স্পর্শ করে সায়ীর উদ্দেশ্যে মনে মনে নিয়ত বা প্রতিজ্ঞা করুন যে, “হে আল্লাহ, আমি আপনার সন্তুষ্টির জন্য সাফা ও মারওয়ার সাঈ করার নিয়ত করছি। ইহা আমার জন্য সহজ করে দিন এবং কবুল করুন” এবং সাফা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হোন। চুম্বন বা স্পর্শ সম্ভব না হলে এক্ষেত্রে ‘হাজরে আসওয়াদ’ এর দিকে ইশারা করার কোন বিধান নেই।
সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অনুসরনে বলুন
ان الصفا و المروة من شعاءر الله – ابدء بما بدء الله به-
(ইন্নাস্ সাফা ওয়াল মার্ওয়াতা মিন্ শা’আ’ইরিল্লাহি, আব্দায়ু বিমা বাদাআল্লাহু বিহি)।
অর্থ : নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন সমুহের মধ্যে অন্যতম। আমি শুরু করছি আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন।
এই দোয়াটি এখানে ছাড়া আর কোথাও পড়বেন না। সা’ঈর প্রথম চক্রের শুরুতেই শুধুমাত্র পড়বেন। প্রতিচক্রে বারবার এটা পুনরাবৃত্তি করবেন না।
এরপর যতটুকু সম্ভব সাফা পাহাড়ের উপরে এতটুকু উঠুন যেন কাবা শরীফ নজরে পড়ে।(এখন আর পাহাড় নেই; মেঝেতে মার্বেল পাথর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।) তারপর কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দুই হাত পর্যন্ত তুলে তিনবার তাকবির বলে (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার) নিচের দোয়াটি তিনবার পড়ুন-
لا إله إلا الله - الله اكبر- لا إله إلا الله - وحده - لا شريك له- له الملك- وله الحمد – يحيى و يميت - وهوا على كل شيء قدير.
(লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ , আল্লাহু আকবার। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াহ্দাহু, লা-শারী’কালাহু। লাহুল্ মুল্ক, ওয়া লাহুল্ হাম্দ। ইউহ্’ঈ ও ইউ-মিতু, ও হুয়া আ-লা কুল্লে শাইয়েন কাদির।)
অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নাই । আল্লাহ মহান । তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নাই। তিনি এক ও একক। তার কোন শরীক নাই। সার্বেভৌমত্বের তিনিই মালিক। সমস্ত প্রশংসা তারই জন্য। তিনি জীবন ও মৃত্যু দিয়ে থাকেন এবং তিনি সর্বময় ক্ষমতার মালিক।
মনে রাখবেন, এই গুরুত্বপূর্ন দোয়াটি পরবর্তীতে মিনা, আরাফা এবং মুজদালিফায় বহুবার পড়তে হবে।
এই দোয়াটি পড়ার পর যত পারেন দুনিয়া ও আখেরাতের অসংখ্য কল্যান চাইতে থাকুন। আরবী ভালভাবে না বুঝলে নিজের ভাষায় আল্লাহর প্রশংসা করুন ও আপনার বৈধ ইচ্ছাগুলো তার দরবারে পেশ করুন। দোয়া শেষ হলে ‘সাফা’ থেকে নেমে ‘মারওয়ার’ দিকে হাটতে থাকুন। আর আল্লাহর যিক্র ও দোয়া করতে থাকুন। নিজের জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য এবং মুসলিম মিল্লাতের সবার জন্য। সাফা থেকে নেমে কিছু দূর এগুলেই উপরে ও ডানে-বামে সবুজ বাতি জ্বালানো দেখবেন। এই সবুজ বাতি জ্বালানোর প্রথম জায়গা/আলামত থেকে পরবর্তী সবুজ বাতি পর্যন্ত পুরুষ হাজীগন দৌঁড়ানোর মত করে দ্রুত গতিতে হেঁটে চলুন (এটা সেই জায়গা যেখানে হযরত হাজেরা (রাঃ) পানির জন্য দৌড়েছিলেন) এবং শেষ সবুজ বাতির আলামতের পরে চলার গতি আবার স্বাভাবিক করুন। তবে নারীদের ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় চলার গতি স্বাভাবিক থাকবে।
সবুজ দুই আলামতের মাঝে চলার সময় নিচের দোয়াটি পড়ুন-
رب اغفر – وارحم - و انت الاعذ الاكرام.
(রাব্বিগ্ফির ওয়ার্হাম ওয়া-আন্তাল্ আ-আজ্জুল্ আক্রাম)
অর্থ : হে আমার রব ! আমাকে ক্ষমা করে দাও ! তুমিতো মহা সম্মানের অধিকরী।
এভাবে হেঁটে মারওয়া পাহাড়ে পৌছে এর উঁচুতে আরোহন করুন। অতঃপর পবিত্র কাবার দিকে মুখ করে ‘সাফা’ পাহাড়ে যা যা পড়েছিলেন ও করেছিলেন সেগুলো এখানেও একই কায়দায় হাত তুলে তিনবার করুন। অর্থাৎ তিনবার ‘আল্লাহ আকবার’ তাকবীর বলে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ও আল্লাহু আকবর” থেকে “ও হুয়া আ-লা কুল্লে শাইয়েন কাদির’- পর্যন্ত পুরাটা তিনবার পড়ুন, অতঃপর দোয়া করুন। ‘সাফা’ থেকে ‘মারওয়া’ য় আসার পর আপনার একচক্র শেষ হলো।
এবার আপনি ‘মারওয়া’ থেকে নেমে আবার ‘সাফার’ দিকে চলতে থাকুন। সবুজ চিহ্নিত দুই বাতির আলামতের মধ্যবর্তী স্থানে পুরুষ হাজীরা আগের মত দৌড়ানোর মত করে দ্রুত গতিতে হেটে চলুন এবং সবুজ বাতির শেষে চলার গতি আবার স্বাভাবিক করুন। ‘সাফা’ পাহাড়ে পৌছে প্রথমবার যা যা পড়েছিলেন ও করেছিলেন এবার ও তা পড়ুন ও করুন। এভাবে প্রত্যেক চক্রেই এ নিয়ম পালন করে যান। ‘সাফা’ থেকে ‘মারওয়া’ গেলে হয় এক চক্র। আবার ‘মারওয়া’ থেকে ‘সাফায়’ ফিরে এলে হয় আরেক চক্র। এভাবে ৭(সাত) চক্র পূর্ণ করুন।
‘সাফা’ থেকে ‘মারওয়া’-র দূরত্ব প্রায় ৪৫০ মিটার - অর্থাৎ ৭(সাত) চক্কর দিলে (একবার সা’ঈ করলে) তিন কিলোমিটারের একটু বেশী পথ অতিক্রম করা হবে।
‘সাফা’ ও ‘মারওয়া’ -উভয়টা দোয়া কবুলের জায়গা। কাজেই ‘সাঈ’-র পথ বেশী মনে করে তাড়াতাড়ি ‘সাঈ’ সেরে নিয়ে বাসায় চলে যাবার চিন্তা করবেন না। ধীরে-সুস্থে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যেখানে যা করেছিলেন, সেখানে সেটা সেভাবেই করার চেষ্টা করুন। কতটুকু করলে ফরজ আদায় হয়ে যাবে এই চিন্তা মাথায় আনবেন না। বরং এটা টার্গেট বানাবেন যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কোথায় কোন কাজ কিভাবে ও কত সময় করেছন, আমি ও ঠিক সেভাবেই করব।
‘সাঈ’ করার সময় সালাত দাঁড়িয়ে গেলে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করুন। ‘সাঈ’ করার সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসে আরাম করে নিন। এতে ‘সাঈ’ করার কোন ক্ষতি হবে না।
‘তাওয়াফ’ করার সাথে সাথেই ‘সাঈ’ জরুরী নয়। তবে ‘তাওয়াফ’ করার সাথে সাথেই ‘সাঈ’ করা সুন্নত। যদি কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়ে বা অন্য কোন শারীরিক অসুবিধার কারনে কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে যায় তা বৈধ।
‘সাঈ’ পায়ে হেঁটে করা ‘ওয়াজিব’। যদি কোন অসুবিধা থাকে তাহলে ট্রলিযোগে ‘সাঈ’ করা যাবে।
উম্রার চতুর্থ কাজঃ হলক (ওয়াজিব)
‘সা’ঈর’ কাজ শেষ করার পর এখন আপনার আমল হচ্ছে ‘হলক’ করা। যার অর্থ সম্পূর্ন মাথা মুন্ডানো বা ছাঁটা। কমপক্ষে পুরুষ হাজীদের মাথার সমস্ত চুলের এক-চুতর্থাংশ ছেঁটে ফেলে দিতেই হবে। সাবধানতার জন্য একটু বেশী ছাঁটুন। সেলুনে গিয়ে চুল কামিয়ে বা মেশিন দিয়ে ছেঁটে নেয়া সুবিধাজনক। মারওয়া পাহাড়ের কাছেই চুল কাটার অনেক সেলুন রয়েছে।
মনে রাখা জরুরী যে চুল ছোট করে কাঁটার চেয়ে মাথা মুন্ডন করার মধ্যে সাওয়াব বেশী। কেননা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মাথা মুন্ডনকারীদের জন্য তিনবার রহমত ও মাগফিরাতের দোয়া করেছেন। অন্যদিকে যারা চুল খাট করে কেঁটেছেন, তাদের জন্য মাত্র একবার উক্ত দোয়া করেছেন।
মহিলাদের জন্য মাথা মুন্ডনের কোন বিধান নেই। তারা ‘সা’ঈ’ শেষে আপন আপন বাসস্থানে গিয়ে মাথার সব চুলের অগ্রভাগ থেকে আঙ্গুলের এক কড়া পরিমান (অর্থাৎ এক ইঞ্চির একটু কম পরিমান) চুল কেটে ফেলুন। স্মরন রাখতে হবে যে, মহিলারা এর চেয়ে বেশী পরিমান চুল কাটবে না এবং চুল নিজে কেঁটে ফেলুন বা কোন মহিলা দ্বারা বা মাহ্রাম ব্যক্তির দ্বারা কেঁটে নিন। কোন বেগানা পুরুষকে দিয়ে কাটানো হারাম।
এখন আপনি উম্রার ইহ্রাম থেকে হালাল হয়ে গেলেন। কাজেই ইহ্রামের পোশাক খুলে স্বাভাবিক পোশাক পরে নিন। এরপর হজ্বের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকুন।
তবে এখানে বিশেষভাবে স্মরন রাখার মত, মুল হজ্ঝ শুরুর আগে অর্থ্যাৎ আট জিলহজ্জের আগে এবং ওমরা পালন শেষে সাথে সাথে সম্ভব হলে কমপক্ষে একটি নফল তাওয়াফের সংগে একটি সাঈ করে নেওয়া উত্তম।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস থেকে বর্নিত- তিনি বলেন নবী করিম (সাঃ) এরশাদ করেছেন- আল্লাহ্তায়ালা প্রত্যেক দিন ও রাত মসজিদে হারামের প্রতি ১২০টি রহমত বর্ষন করে থাকেন। তন্মধ্যে এই ঘরের তাওয়াফকারীগনের প্রতি ৬০টি, এতে নামাজ আদায়কারীগন মুসল্লীদের প্রতি ৪০টি এবং এই ঘরের প্রতি দৃষ্টিদানকারীগনের প্রতি ২০টি রহমত দান করেন। সুতরাং মক্কাশরীফে অবস্থানকালে অধিক পরিমানে তাওয়াফ করতে থাকুন, কেননা এই তাওয়াফ দুনিয়ার আর কোথাও নাই।
হজ্জ পালনে কাজের ধারাবাহিকতাঃ দিনওয়ারী হজ্জের করনীয় কাজ
বাংলাদেশের মানুষ সাধারনতঃ ‘তামাত্তো হজ্জ’ করে থাকেন। হজ্জের মাসসমূহে (শাওয়াল, যিলক্বদ ও জিলহজ্জ) উম্রার ইহ্রাম বেঁধে প্রথমে উম্রা পালন করে ইহ্রাম খুলে ফেলা; অতঃপর হজ্জের জন্য পুনরায় ইহ্রাম বেঁধে হজ্জ সম্পন্ন করাকে ‘তামাত্তো হজ্জ’ বলে।
৮ জিলহজ্জ থেকে ১২ জিলহজ্জ পর্যন্ত এই পাঁচ দিনকে ‘আইয়ামে হজ্জ’ বা হজ্জের দিন বলা হয়। এই দিনগুলোতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ন রোকন- হজ্জ পালন করা হয়। ৮ তারিখ সকালে হাজী সাহেবানরা ৪/৫ দিনের উপযোগী ‘প্রবাস সরঞ্জাম’ নিয়ে মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য প্রস্তুত থাকেন। মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব ৪/৫ কিলোমিটার।
৮ জিলহজ্জঃ তারওয়ীয়াহ্র দিন
হজ্জের প্রথম দিন
আজ থেকে হজ্জের পাঁচদিন আরম্ভ হল। আপনি বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে একজন ‘তামাত্তো হজ্জ’ পালনকারী। তাই ওমরাহ্র সময় যেভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ইহ্রাম বেঁধেছিলেন, আপনার হোটেল বা বাসা থেকেই সেভাবে ইহ্রাম বাঁধুন। (তবে কুরবানীকারীরা ১লা জিলহজ্জ থেকে কোরবানীর পূর্ব পর্যন্ত চুল-নখ কাটবেন না।) ইহ্রাম বাঁধার সময় এভাবে নিয়ত করুন- لبيك حجا (লাব্বাইকা হাজ্জ্বান) অর্থঃ হে আল্লাহ আমি হজ্জ্বের জন্য প্রস্তুত) নিয়তের সাথে সাথে নিম্মের দোয়া পড়ুনঃ
اللهم انى اريد الحج قيسره لي و تقبله منى-
(“আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল হাজ্জা ফাইয়াস্সিরহুলি ওয়া তাকাব্বাল্হু মিন্নি”।)
অর্থঃ হে আল্লাহ, আমি হজ্জ পালন করার নিয়ত করছি। আপনি আমার এই হজ্জ আমার জন্য সহজ করে দিন এবং তা কবুল করে নিন।
দোয়া শেষ হওয়ার সাথে সাথে তিনবার তালবিয়া অর্থাৎ “লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, .................. “ একটু উচ্চস্বরে পড়ুন। (মহিলারা নীরবে পড়ুন)।
মনে রাখবেন যে হজ্জের জন্য ইহ্রাম বাঁধা ফরজ। তাই ইহ্রামের নিয়তের সাথে সাথে অবশ্যই তালবিয়া পাঠ করবেন। অন্যথায় ইহ্রাম শুদ্ধ হবে না এবং ইহ্রাম শুদ্ধ না হলে হজ্জ সহীহ্ হবে না।
এভাবে হজ্জের ইহ্রাম বাঁধা হয়ে গেল। সর্বদা তালবিয়া পাঠ করতে থাকুন এবং মোয়াল্লেমের গাড়ীর অপেক্ষায় থাকুন। সতর্ক থাকুন, যেন কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ না হয়। অনর্থক কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকুন। তারপর গাড়ী আসলে তালবিয়া পড়ে পড়ে মিনার দিকে রওয়ানা হন।
সূর্যোদয়ের পর মিনার দিকে রওয়ানা হওয়া সুন্নত। তাই চেষ্টা করুন, এ সুন্নতটি যেন ছুটে না যায়। তবে যদি মুয়াল্লেমের গাড়ী আগেই চলে আসে, তবে সূর্যোদয়ের আগেই চলে যান। এতে কোন সমস্যা হবে না। তবে এ দিন জোহরের আগেই মিনায় পৌঁছে জোহরের নামাজ পড়বেন। অতঃপর আসর, মাগ্রিব ও এশা এবং ৯ জিলহজ্জ ফরজ নামাজ আদায় করবেন। আপনি মুসাফির না মুকিম সে কথা বিবেচনায় রেখে চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজ দু’রাকাত করে কসর অথবা পুর্নাংগ আকারে পড়ুন। ৮ জিলহজ্জের আগে যদি আপনি মক্কা শরীফে মুকীম হিসাবে কমপক্ষে ১৫ দিন অবস্থান করে থাকেন, তবে মিনা, আরাফা ও মুজদালিফায় পুরো নামাজ পড়বেন। আর তা না হলে এসব স্থানে কসর পড়বেন। প্রতি বছরই এই মাসয়ালা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়।
৮ জিলহজ্জ দুপুর থেকে ৯ জিলহজ্জ ফজর বাদ সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। এ সময়ে বেশী বেশী কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার এবং মুসলিম উম্মার জন্য আল্লাহ্র কাছে রহমত কামনা করুন।
৯ জিলহজ্জঃ উকুফে আরাফা
হজ্জের দ্বিতীয় দিন
জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখকে ‘ইয়াউমে আরাফা’ -আরাফা দিবস বলে। আজ আরাফার মোবারক দিন। মিনা থেকে আরাফা ১৫/১৬ কিলোমিটার দূরত্ব। এইদিন ভোরে ফজরের নামাজ মিনায় আদায় করে তাকবীরে তাশরীক ও তিনবার তালবিয়া পাঠ করুন। তাকবীরে তাশরীক নিম্নরূপঃ
الله أكبر- الله أكبر- لا إله إلا الله- والله أكبر- الله أكبر-و لله الحمد.
(আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবর। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু অ-আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবর। ওলিল্লাহিল্ হাম্দ)।
অর্থঃ আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নাই। আল্লাহ্ মহান, আল্লাহ্ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য।
অতঃপর সূর্যোদয়ের পর ‘তালবিয়া’ পড়া অবস্থায় মু’আল্লিমের গাড়ীতে রওয়ানা হবেন আরাফা অভিমুখে এবং দুপুরের পূর্বেই মিনা থেকে আরাফার ময়দানে পৌঁছান। তবে বর্তমানে হজ্জযাত্রীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ফজরের পূর্বেই নিয়ে যাওয়া হয় আরাফায়। এটা নিশ্চয়ই সুন্নতের খেলাপ। তবে ওজরের কারনে এ সুন্নত ছুটে গেলে কোন সমস্যা হবে না।
দুপুর থেকে ‘উকুফে আরাফা’ শুরু। এ সময় এখানে গোছল করাকে কেউ কেউ মুস্তাহাব বলেছেন। না পারলে ওযুই যথেষ্ট।
৯ জিলহজ্জ ফজর নামাজের পর থেকে ১৩ জিলহজ্জ আসর পর্যন্ত আপনি যেখানেই থাকুন প্রতি ফরজ নামাজের পর ‘তাকবীরে তাশরীক’ পড়ুন এবং এটা ওয়াজিব।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হচ্ছে হজ্জ’। আর এ কারনেই আরাফাতের ময়দানে দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা ফরজ।
জোহর ও আসরের নামাজ জোহরের প্রথম ওয়াক্তে এক আযান ও দু’ইকামাতে মুকিম বা মুসাফির হিসাবে (যার জন্য যেটি প্রযোজ্য) সম্পূর্ন বা কসর আকারে পড়ুন। কেননা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামদেরকে নিয়ে যোহর আসর একসাথে আদায় করেছিলেন। যদি সম্ভব হয় মসজিদে নামিরাতে গিয়ে ইমামের পিছনে জোহর ও আছরের নামাজ একসাথে উপরের নিয়মে পড়বেন এবং নামাজ শেষে আপনার অবস্থানস্থলে ফিরে যাবেন। মনে রাখবেন আরাফাহ্র পুরোটা ময়দানই অবস্থানস্থল।
আরাফায় অবস্থানের সময় বিশেষভাবে লক্ষ রাখবেন যাতে অবস্থান সঠিক হয়। কারন আরাফাত সংলগ্ন ‘আরানা উপত্যকা’ অবস্থিত। সেখানে ‘মসজিদে নামিরা’ অবস্থিত। হাজীদের ভুল করে এই উপত্যকায় অবস্থান করতে দেখা যায়।
আরাফা দিবসের মূল আমল দোয়া। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরাফার ময়দানে উকুফের সময় কেবলামুখী হয়ে হাত উঠিয়ে বিরতিহীনভাবে দোয়া করেছেন। এমনভাবে হাত উঠিয়ে তিনি দোয়া করেছেন যে, একবার উট হেলে যাওয়ার কারনে উটের লাগাম পড়ে যায়। তিনি এক হাত দিয়ে লাগামটি উঠালেন, ও অন্য হাত দোয়ার জন্য উঠিয়েই রাখলেন। সে কারনে ‘উকুফে আরাফার’ সময় আমাদেরও কর্তব্য হাত উঠিয়ে নিরন্তরভাবে দোয়া করে যাওয়া।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, সবচেয়ে উত্তম দোয়া আরাফাহ্ দিনের দোয়া। আর সর্বোত্তম দোয়া হলো এই দোয়া, যা আমি ও আমার পুর্বেকার নবীগন (আঃ) চেয়েছেন। তা হলো এই-
لا إله إلا الله وحده لا شريك له، له الملك وله الحمد وهو على كل شيء قدير-
(লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়দাহু লা শরিকালাহু লাহুল মুল্কু ওলাহুল্ হামদু ও-হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির)
অর্থঃ আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। তিনি এক, তার কোন শরীক নাই। সমস্ত জগতের মালিক তিনি। সমস্ত প্রশংসা তারই জন্য। তিনি সকল বস্তুর উপর পূর্ন ক্ষমতাবান।
এরপর নিম্নের দোয়াগুলি পরপর পড়ুন। সম্ভব হলে ১০০ বার পড়ুন। দোয়াগুলি হলো-
لا إله إلا انت سبحانك انى كنت من الظلمين-
(লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা সুব্হানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ্জলিমিন)
অর্থঃ তুমি ছাড়া কোন মা’বুদ নাই। তুমি পাক পবিত্র। নিশ্চয়ই আমি অত্যাচারীদের অন্তর্ভূক্ত।
سبحان الله والحمد لله و لا اله إلا الله و الله أكبر و لا حول و لا قوة الا بالله العلى العظيم.
(ছুব্হানাল্লাহি ওল্হাম্দুলিল্লাহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওলাহাওলা ও’লাকুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল্ আলিউল আজিম)
অর্থঃ পাক পবিত্র আল্লাহ্। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য। নাই কোন ইলাহ আল্লাহ ছাড়া। আল্লাহ মহান। নাই কোন ক্ষমতা কারও কোন কল্যান করার এবং নাই কোন শক্তি বিপদ আপন দূর করার।
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ - اللَّهُ الصَّمَدُ- لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ - وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ.
(কুল হুয়াল্লাহু আহাদ। আল্লাহুচ্ছামাদ। লাম্ ইয়ালিদ ওলাম্ ইউলাদ্। অলাম ইয়াকুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ।)
অর্থঃ বল, [হে মুহাম্মদ (সাঃ)] তিনি (আল্লাহ) এক, তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাকে ও জন্ম দান করেননি এবং নিজেও জন্মগ্রহন করেননি এবং তার সমকক্ষ কেউ নেই।
এভাবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অনুনয় বিনয়ের সাথে জিকিরও দোয়ার মধ্যে ব্যস্ত থাকুন। এছাড়াও যত কিছু দোয়া আপনার মুখস্ত আছে, তা সব পড়ুন। সাথে ওজিফার কিতাব থাকলে তা পড়ুন। নিজকে নিজে বলুন এমন দিন, এমন মূহুর্ত হয়ত জীবনে আর নাও আসতে পারে। আজকের দিনেও যদি গোনাহ্ মাফ না হয়, তবে আর কবে হবে? নিজের বিগত জীবনের সমস্ত গোনাহ্ মাফ করিয়ে পাক সাফ হতে হবে। চোখের পানি দিয়ে পাপ-তাপ ধুয়ে মুছে পবিত্র হতে হবে। যেমন করে হোক, যেভাবেই হোক আল্লাহ্পাকের নিকট থেকে এই সময়ে নিজের সমস্ত গোনাহ্ মাফ করিয়ে নিতে হবে। দোয়ার শেষে নামাজে আমরা যে দরুদ শরীফ পড়ি তা পড়ুন।
আপনার জন্য একটা বিশেষ পরামর্শ। আপনি যে তাবুতে আছেন, যদি কোন কারনে ঐ তাবুর পরিবেশ ভাল না হয়, তবে পাশ্ববর্তী অন্য তাবুতে অথবা কোন গাছের ছায়ায় বা খোলা আকাশের নীচে (সম্ভব হলে দাঁড়িয়ে) অত্যন্ত একাগ্রচিত্তে ভয় ও ভক্তির সাথে দোয়ায়/এবাদতে মশগুল থাকুন। মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যাপার। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু সাথে থাকলে কান্নাকাটি করতে অনেক সময় অসুবিধা হয়। আরাফাতের প্রতিটি মূহুর্তই অত্যন্ত মূল্যবান। এই বিশ্বাস রাখুন যে, লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে আপনার দোয়াও কবুল হবে, ইনশাআল্লাহ্। এটা দোয়া কবুলের স্থান ও সময়।
যদি সাথে কোন মহিলা থাকেন, তবে তিন চারটি বড় চাদর এবং কিছু সেফটিপিন সাথে রাখুন যেন আরাফার তাবুর মধ্যেই চাদর দিয়ে পর্দা করতে পারেন।
৯ জিলহজ্জ সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দানে বা রাস্তায় কোথাও মাগরিবের নামাজ না পড়ে সোজা মুযদালিফা-র দিকে যাত্রা করুন। কাউকে কোন ধরনের কষ্ট না দিয়ে অত্যন্ত শান্ত ও এত্মিনানের সাথে আল্লাহর যিকিরে মশগুল থেকে পথ চলুন। ভাড়ার গাড়ীতে ৩০/৪০ রিয়ালে বা মুয়াল্লিমের গাড়ীতে আরাফা থেকে মুযদালিফায় যাওয়া সুবিধাজনক। তবে সূর্যাস্তের প্রায় দেড়-দুঘন্টা পরে গাড়ী চলাচল শুরু হয়।
এখানে মনে রাখবেন যে আরাফার সীমানা শেষ হলেই মুয্দালিফা শুরু হয় না। আরাফা থেকে প্রায় ৬ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করার পর আসে মুয্দালিফা। মুয্দালিফার পর ‘ওয়াদি আল-মুহাস্সর’। আরাফা থেকে যেতে দু’পাশে সামনাসামনি দুটি পাহাড় পড়বে। এই পাহাড়দ্বয় থেকে ওয়াদি আল মুহাস্সর পর্যন্ত মুযদালিফা। মুযদালিফার শুরু ও শেষ নির্দেশকারী বোর্ড রয়েছে।
মুযদালিফায় পৌঁছে প্রথম কাজ হলো এশার ওয়াক্তে এক আযান এবং দুই একামত দ্বারা পর্যায়ক্রমে মাগরিবের ফরজ পড়ে এশার ফরজ নামাজ আদায় করুন। এই দুই ফরজ নামাজ একসাথে পড়া এখানে ওয়াজিব। ফরজ আদায়ের পর বেতেরের নামাজ ও আদায় করুন। মুয্দালিফায় নামাজ আদায়ের এটাই বিশুদ্ধ পদ্ধতি। খেয়াল রাখতে হবে যে মুযদালিফায় পৌঁছার পর যদি এশার নামাজের সময় না হয় তবে এশার ওযাক্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে এবং প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তাকবীর-ই-তাশরীক পড়ার কথা স্মরন রাখুন।
নামাজ আদায়ের পর আর কোন কাজ নেই। তাই খাওয়া-দাওয়া শেষে বিশ্রাম নিতে পারেন। কেননা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হজ্জের সময় সুব্হে সাদিক পর্যন্ত শুয়ে আরাম করে গেছেন। তবে শক্তি সামর্থ্য থাকলে মুযদালিফার মসজিদে (আল মাশআরুল হারাম) এসে নামাজ পড়তে পারেন এবং মসজিদের বারান্দা বা আশে-পাশে অবস্থান করতে পারেন। আরো সুবিধা আছে। ঐ মসজিদেই ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করার পর সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত অবস্থান করে যিকির আয্কার ও ইবাদতে সময় অতিবাহিত করা বেশ সুবিধাজনক।
আপনি অবশ্যই মনে রাখবেন যে সুবেহ্ সাদিক থেকে সূর্যোদয়ের পূর্ব সময়ের মধ্যে কিছুক্ষন মুযদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। কাজেই মুযদালিফার মসজিদে বা উহার কাছে গিয়েই হোক বা আপনি যেখানে অবস্থান করছেন, সেখানেই হোক ফজরের নামাজ আদায়ের পর হাত উঠিয়ে দোয়ায় মশগুল হবেন ও খুব ফর্সা হওয়া পর্যন্ত দোয়া ও যিকির চালিয়ে যাবেন। আরাফাতে অবস্থানকালে যে দোয়া পড়েছিলেন এখানেও সেই দোয়া পড়তে পারেন। এরপর সূর্যোদয়ের আগেই মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন।
পরামর্শঃ মুযদালিফায় অবস্থানকালে এক ফাঁকে কংকর কুড়িয়ে নিতে পারেন। কেননা মিনায় গিয়ে কংকর খুজে পাওযা রীতিমত কষ্টের ব্যাপার। তবে মুযদালিফা থেকেই কংকর নিতে হবে এ ধারনা ঠিক নয়। মটরশুঁটি আকারের কংকর নেবেন যা আংগুল দিয়ে নিক্ষেপ করা যায়। ৭০(সত্তর)টি কংকর কুঁড়াবেন। কংকর পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে এমন কোন বিধান নেই।
১০ জিলহজ্জঃ ঈদের দিন
হজ্জের তৃতীয় দিন
আজ ১০ জিলহজ্জ। হজ্জের বড় দিন- বছরের সর্বোত্তম দিবস। মিনায় পৌঁছে এই দিনে আপনি হজ্জের চারটি কাজ করবেন। সেগুলো নিম্নরূপঃ
১. জামারায়ে আকাবা বা বড় শয়তানের গায় ৭(সাত)টি কংকর নিক্ষেপ করবেন (ওয়াজিব);
২. কুরবানী করবেন;
৩. মাথা মুন্ডন বা চুল ছোট করবেন ও ইহ্রাম ছেড়ে সাধারন পোশাক পরবেন এবং
৪. কাবা শরীফ তাওয়াফে জিয়ারত করবেন এবং সাফা-মারওয়া সাঈ করবেন এবং জিয়ারত শেষে মিনাতে রাত্রি যাপন করার জন্য ফিরে আসবেন। এটি এদিন না পারলেও তা ১১ বা ১২ তারিখেও করতে পারবেন।
কংকর নিক্ষেপ
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সূর্য ওঠার প্রায় দেড়-দুই ঘন্টাপর কংকর মেরেছিলেন। সে হিসাবে এ সময়টাতেই ১০ তারিখের কংকর নিক্ষেপ করা সুন্নত। সূর্য ঢলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এ সুন্নত সময় চলতে থাকে। তবে সূর্য ঢলে যাওয়া থেকে শুরু করে ১১ তারিখের সুব্হে সাদিকের আগ পর্যন্তও বড় জামরায় কংকর মারা জায়েজ। বর্তমান যুগে বিশ লক্ষাধিক হজ্জ পালনকারীর ভিড়ে সুন্নত আদায় করা অনেকের পক্ষেই কষ্টকর। তাই প্রথমে খবর নিন, কখন ভিড় কম থাকে। অনেক সময় সকাল বেলা ভিড় কম থাকে। কেননা অনেকেই ভাবেন যে, এখন মনে হয় প্রচন্ড ভিড়, তাই পরে যাই। আবার অনেক সময় সকাল বেলায় প্রচন্ড ভিড় থাকে। তাই আপনার উচিৎ হবে, ভিড় আছে কিনা তা খবর নিয়ে দেখা। তবে ১০ জিলহজ্জ সূর্যোদয় থেকে শুরু করে ১১ জিলহজ্জ সুবেহ সাদিক উদয়ের আগ পর্যন্ত ১০ তারিখের কংকর মারা চলে, এটাই আপনি মাথায় রাখুন। তাই এই সময়ের মধ্যে যখন ভিড় কম বলে খবর পাবেন, তখনই কংকর মারতে যাবেন।
নারীদের জন্য বিকেলবেলা ও রাতে কংকর মারা সহজ। কেননা, ঐ সময়ে সাধারনত লোক সমাগম কম থাকে। তবে যারা দূর্বল, অর্থাৎ হাটা-চলায় সামর্থ্য রাখে না, তারা নিজের কংকর অন্যকে দিয়ে মারাতে পারেন। এক্ষেত্রে যিনি প্রতিনিধি হবেন, তাকে অবশ্য হজ্জ পালনকারী হতে হবে এবং নিজের কংকর প্রথমে মেরে পরে অন্যেরটা মারবেন।
এখন কংকর মারার জন্য তালবিয়া পড়ে পড়ে বড় জামরার দিকে অগ্রসর হন। মিনার দিক থেকে তৃতীয় আর মক্কার দিক থেকে প্রথম জামরাকে জামরায়ে আকাবা বা বড় শয়তান বলে। কংকর মারার নিয়ম হচ্ছে, কংকর নিক্ষেপের সময় মিনাকে ডান দিকে এবং কাবাকে বাম দিকে রেখে দাঁড়ান। শাহাদাৎ ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা কংকর ধরে চিহ্ন থেকে অন্তঃত ৫(পাঁচ) হাত দুরে দাঁড়িয়ে স্তম্ভের জায়গায় কংকর নিক্ষেপ করুন। প্রথম কংকর মারার পুব মূহুর্তে তালবিয়া পড়া বন্ধ করে দিন। প্রতিটি কংকর ভিন্ন ভিন্নভাবে মারার সময় বলুনঃ বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর। স্তম্ভের চারপার্শে বৃত্তাকারে সীমা নির্ধারন করে দেয়া জায়গাটির ভিতরেই কংকর পড়তে হবে। যদি কোন কংকর এর ভিতরে না পড়ে কিংবা সজোরে স্তম্ভে লেগে বাইরে ছিটকে পড়ে, আরেকটি কংকর নিক্ষেপ করতে হবে, নতুবা কাফ্রার দিতে হবে।
কুরবানী
বড় জামরায় কংকর মারা শেষ করে হজ্জের শোকরিয়া হিসাবে কুরবানী করা ওয়াজিব। নিজ হাতে করুন কিংবা কাউকে পাঠান; তবে যবেহ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হোন। মিনায় কোরবানী করতে না পারলে মক্কা শহরেও কুরবানী করতে পারেন, জায়েজ আছে। উট-গরু-বকরি-মেষ কোরবানী হিসাবে যবেহ করা যায়। উট হলে ৫ বছর বয়সের, গরু হলে ২ বছর বয়সের ও মেষ হলে ১ বছর বয়সের হতে হবে। উট ও গরু হলে একটাতে ৭জন অংশ নিতে পারবেন। বকরি ও ভেড়ার ক্ষেত্রে একটি পশু একজনের কোরবানী হিসাবে যবেহ করবেন।
মাথা মুন্ডন
পশু কুরবানীর পর মাথা মুন্ডন বা চুল ছোট করুন। তবে মুন্ডন করাই উত্তম। মাথা মুন্ডানো হোক বা চুল ছোট করা হোক সমস্ত মাথা ব্যাপ্ত করা সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সমস্ত মাথা ব্যাপ্ত করে মুন্ডন করেছিলেন। মাথার কিছু অংশ মুন্ডন করা অথবা ছোট করা, আর কিছু অংশ ছেড়ে দেয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর আদর্শের বিপরীত।
আপনার মাথা মুন্ডনের কাজটি মিনায় হওয়া সুন্নত। কেবলামুখী হয়ে বসা এবং ডানদিক থেকে চুল ছাটা ও সুন্নত। মহিলাগন তখনি তাদের চুলের আগা থেকে এক গিরা বা ততোধিক পরিমান কাটবেন, যখন পুরুষেরা কোরবানী করে ফিরে এসে তাদেরকে বলবেন।
মাথা মুন্ডনের পর আপনি হালাল হয়ে গেলেন। এবার ইহ্রাম খুলে নিন। কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্ক এখনও নিষিদ্ধ। তাওয়াফে জিয়ারতের পর জায়েজ।
তাওয়াফে জিয়ারত
১০ জিলহজ্জের চতুর্থ আমল হলো তাওয়াফে জিয়ারত। তাওয়াফে জিয়ারত ১০ তারিখেই সেরে নেয়া ভালো। কিন্তু ১০ তারিখ সম্ভব না হলে ১১ বা ১২ তারিখের সূর্যাস্তের পূর্বে অবশ্যই এ তাওয়াফ করতে হবে। কংকর নিক্ষেপ, কুরবানী করা এবং ক্ষৌরকার্য এ তিনটি আমল শেষ করে গোছল করে, সুগন্ধি মেখে সেলাইযুক্ত কাপড় পড়ে আপনি কাবার দিকে রওয়ানা হবেন। শুরুতে ওমরা আদায়ের সময় যে নিয়মে তাওয়াফ করেছেন, ঠিক সে নিয়মেই তাওয়াফ করবেন। তবে এ তাওয়াফে রামল ও ইযতেবা নেই। এ তাওয়াফটি হলো হজ্জের ফরজ তাওয়াফ। তাওয়াফের পর উমরাহ্ অধ্যায়ে বর্নিত পদ্ধতিতে সাফা-মারওয়ার সাঈ করবেন।
মহিলারা হায়েজ অবস্থায় জিয়ারত করতে পারবেন না। যখন পবিত্র হবেন, তখন তাওয়াফে জিয়ারত করবেন। এজন্য দম দিতে হবে না। তবে যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে মাসিক বন্ধ হওয়ার সময় পর্যন্ত কোনক্রমেই অপেক্ষা করা যাচ্ছে না, ও পরবর্তীতে এসে তাওয়াফে জিয়ারত আদায় করে নেয়ারও সুযোগ নেই, তাহলে ন্যাপকিন দিয়ে ভাল করে বেঁধে তাওয়াফে জিয়ারত সেরে নেয়া বৈধ আছে।
তাওয়াফ এবং সাঈ শেষ করে মিনায় ফিরে আসবেন। ১০ তারিখ দিবাগত রাত ও ১১ তারিখ দিবাগত রাত মিনায় অবস্থান করা ওয়াজিব। আবার ১২ তারিখ যদি মিনায় থাকা অবস্থায় সূর্য ডুবে যায়, তাহলে ১২ তারিখ দিবাগত রাতেও মিনায় থাকা ওয়াজিব হয়ে যায়। ১৩ তারিখ কংকর মেরে তারপর মিনা ত্যাগ করবেন।
১১ জিলহজ্জঃ আইয়ামে তাশরীকের ১ম দিন
হজ্জের চতুর্থ দিন
১১ জিলহজ্জ সূর্য ঢলে যাবার পর তিন জামরায়ে কংকর নিক্ষেপ করবেন। প্রথমে ছোট জামরায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করবেন। কাবা শরীফ বামে ও মিনা ডানে রেখে দাঁড়াবেন। খুশু খুজুর সাথে আল্লাহ্র শিয়ারের-নিদর্শনের যথাযথ তাজিম বুকে নিয়ে একটি একটি করে কংকর নিক্ষেপ করবেন। ‘আল্লাহু আকবর’- বলে প্রতিটি কংকর নিক্ষেপ করবেন। ছোট জামরায় কংকর মারা শেষ হলে একটু সামনে এগিয়ে যাবেন। কেবলামুখী হয়ে দাড়াবেন ও হাত উঠিয়ে দীর্ঘ মোনাজাত করবেন। এরপর মধ্য জামরায় যাবেন। এখানেও ৭টি কংকর একই কায়দায় নিক্ষেপ করবেন। নিক্ষেপের পর সামান্য এগিয়ে কেবলামুখী হয়ে দাড়িয়ে আবার দীর্ঘ মোনাজাত করবেন। এরপর বড় জামরায় কংকর মারতে যাবেন। নিয়মমত এখানেও ৭টি কংকর মারবেন। তবে এবার আর কোন দোয়া করবেন না। কেননা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বড় জামরায় কংকর মারার পর আর দাড়াননি। কংকর মারা শেষ হলে তাবুতে ফিরে যাবেন।
১২ জিলহজ্জঃ আইয়ামে তাশরীকের ২য় দিন
হজ্জের পঞ্চম দিন
ঠিক গতকালের মত দুপুরের পর প্রথমে ছোট, তারপর মধ্যম, তারপর বড় জামরায় ৭টি করে মোট ২১টি কংকর মারবেন। ছোট ও মধ্যম জামরায়ে কংকর মারার পর কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘ মোনাজাত করবেন। আপনি ইচ্ছা করলে এই তারিখে পাথর মেরে সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে পারেন। তাই দেখা যায় অনেকেই ১২ তারিখে মক্কায় ফিরে যান। সেজন্য তাড়াহুড়া করতে গিয়ে দুপুরের আগেই কংকর মেরে ফেলেন; অথচ এটা নাজায়েজ। দুপুরের পরে পুনরায় তাদের কংকর নিক্ষেপ করতে হবে, নতুবা দম দিতে হবে।
১৩ জিলহজ্জঃ আইয়ামে তাশরীকের ৩য় দিন
হজ্জের ৬ষ্ঠ দিন
১২ জিলহজ্জ মিনায় থাকা অবস্থায় সূর্য ডুবে গেলে মিনাতেই রাত কাটাতে হবে এবং ১৩ তারিখ দুপুরের পর পূর্ব বর্নিতভাবে পর্যায়ক্রমে ছোট, মধ্যম ও বড় জামরায় কংকর মেরে মক্কা শরীফে ফিরে আসবেন। মক্কায় পৌছার পর বিদায়ী তাওয়াফ ছাড়া হজ্জের জন্য আর কোন জরুরী কাজ বাকী নাই। আপনি ইচ্ছা করলে ১৪ জিলহজ্জ হতে মসজিদে আয়শা (তানয়ীম) থেকে ইহ্রাম বেঁধে নফল উমরাহ্ করতে পারেন।
মক্কা শরীফ থেকে বিদায়ের পূর্বে বিদায়ী তাওয়াফ করা ওয়াজিব। এতে ইজতেবা, রমল ও সাঈ নেই।
বিদায়ী তাওয়াফের সময় যদি কোন মহিলা হায়েজ অবস্থায় থাকেন এবং তার পাক হওয়া পর্যন্ত মুহরিম ব্যক্তি যদি বিলম্ব করতে অপারগ হন, তাহলে ঐ মহিলার উপর বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব থাকবে না। তার উচিৎ কাবা শরীফে প্রবেশ না করে দরজার নিকট দাড়িয়ে দোয়া চেয়ে রওয়ানা হয়ে যাওয়া।