উমরার প্রথম কাজঃ ইহ্রাম বাঁধা (ফরজ)
ইহ্রাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হারাম করা। হাজী সাহেবগন হজ্ব অথবা উমরা অথবা উভয়টা পালনের উদ্দেশ্যে নিয়ত করে যখন তালবিয়া পাঠ করেন, তখন তাদের উপর কতিপয় হালাল ও জায়েয বস্তুও হারাম হয়ে যায়। এ কারনেই এ প্রক্রিয়াটিকে ইহ্রাম বলা হয়। নামাজ যেমন নিয়ত ও তাকবীরে তাহ্রীমার দ্বারা শুরু হয়, তেমনি ইহ্রামের দ্বারা হজ্ব ও উমরার কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। মনে রাখা আবশ্যক যে, মীকাত থেকে ইহ্রাম বাঁধা সুন্নাত। যদি কেউ তার পূর্বেই ইহ্রাম বাঁধে, তবে তার ইহ্রাম শুদ্ধ হবে যদিও তার একটি সুন্নত বাদ পড়ে গেল।
আমরা বাংলাদেশীরা যদি বিমানে সরাসরি মক্কায় যাবার নিয়ত করি, তবে ইয়েমেনের মীকাত অনুসরন করে আমাদেরকে ইয়ালামলাম থেকে ইহরাম বাঁধতে হবে। কিন্তু এ স্থানটি যেহেতু জেদ্দার একটু আগে এবং এখানে বিমান অপেক্ষা করার মত অবস্থা থাকে না এবং বিমানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও গোছলের ব্যাপক সুবিধা নেই। অনুরূপভাবে যারা বয়োবৃদ্ধ ও বিমানের নতুন যাত্রী তাদের জন্য বিমানে বসে ইহ্রামের পোশাক পরিধান ঝুঁকিপূর্ন। তাই আমাদেরকে ঢাকায় বিমানে ওঠার আগেই ইহ্রাম বেঁধে নিতে হবে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ঢাকায় বসে যে ইহ্রাম বাঁধা হয়েছে তা প্রকৃত ইহ্রাম নয়। প্রকৃত ইহ্রামের বাস্তব সূচনা অবশ্যই হবে বিমান ছাড়ার অন্ততঃ ৫ঘন্টা পরে ইয়ালামলাম পর্বতের কাছাকাছি আসার পর। সৌভাগ্যের বিষয় যে বিমান সাধারনতঃ ইয়ালামলামের কাছাকাছি এলেই বিমান কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের অবহিত করেন যে, “কিছুক্ষনের মধ্যেই বিমান ইয়ালামলাম মিকাত অতিক্রম করবে।“ তখনই বাংলাদেশী হজ্জযাত্রীদের কর্তব্য হলো প্রকৃত ইহ্রাম বাঁধা এবং লাব্বাইক বলে তালবিয়া পাঠ করা। আর যদি আমরা সরাসরি মক্কায় না গিয়ে মদিনা শরীফে আগে যাই, তবে আমাদেরকে মদিনায় গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের মত জুল-হুলায়ফা তথা আবওয়াবে আলী থেকে ইহ্রাম বাধতে হবে। তবে উত্তম হলো প্রথমে মক্কায় হজ্জ্ব শেষ করে পরে মদিনায় জিয়ারত করা।
পুরুষের জন্য সেলাইবিহীন ৫ হাত লম্বা একখানা সাদা রংয়ের কাপড় লুঙ্গির মত পরতে হবে এবং ৫ হাত লম্বা আরেকখানা সাদা কাপড় এমনভাবে পরতে হবে যাতে দুই কাঁধ ও পিঠ ঢেকে যায়। এভাবে পুরুষদের ইহরামের কাপড় পরা শেষ করতে হবে। অন্যদিকে মহিলাদের ইহ্রামের জন্য শরীয়ত কোন পোশাক নির্দিষ্ট করে দেয়নি। মহিলাদের ইহ্রামের জন্য স্বাভাবিক পোশাকই পরতে হবে। তবে পোশাক আট-সাট বা এমন মিহি যেন না হয় যাতে শরীর স্পষ্ট হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। তবে সবচেয়ে ভাল হয় এমন পোশাক পরা যা মানুষের দৃষ্টি কাড়বে না। আলেমগন এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, মহিলা তার কামিজ, ওড়না, সেলোয়ার, পা মোজাসহ ইহ্রাম করতে পারে। লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ইহ্রাম অবস্থায় মহিলারা নেকাব ও পরবে না, আবার হাত মোজাও পরবে না। কিন্তু যদি অপরিচিত পুরুষ (বেমাহরাম) মহিলাদের পাশ দিয়ে যায়, তবে মাথার ওড়না দিয়ে তারা মুখ ঢেকে রাখবে এবং মাথার পর্দার জন্য টুপি ব্যবহার করবে।
ইহ্রাম বাঁধার জন্য বিশেষ কোন নামাজ নেই। তবে কোন ফরজ বা নফল নামাজের পরে ইহ্রামটি হওয়া মুস্তাহাব। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাধারনতঃ ফরজ নামাজের পরে ইহ্রাম বাঁধতেন। তাই ফরজ নামাজের সময় হলে ইহ্রামের কাপড় পরার পর নামাজ আদায় করতে হবে। আর ফরজ সালাতের সময় না হলে ইহ্রামের কাপড় পরিধান করার পর মাকরূহ ওয়াক্ত (ফজরের ফরজ নামাজের পর থেকে সুর্যোদয় পর্যন্ত এবং আছরের নামাজের পর থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত) না হলে তাহিয়্যাতুল ওজুর দু’রাকাত সালাত পড়ে নিতে হবে।
প্রথম রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সুরা কাফেরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সুরা এখলাস পড়ুন। তবে স্মরন রাখা অত্যন্ত জরুরী যে ইহ্রাম বাধার পূর্বে যাবতীয় ক্ষৌরকর্ম সম্পাদনের পর গোছল করে পাক-পবিত্র হয়ে অথবা গোছলে অপারগ হলে ভালভাবে ওজু করে (আতর-সুগন্ধি ব্যহার করলে ভাল) নিতে হবে।
এরপর সালাত শেষে সালাম ফেরানোর পর মাথার টুপি খুলে রাখতে হবে এবং ইহ্রাম বাঁধার জন্য এভাবে নিয়ত করুনঃ
لبيك عمرة (লাব্বাইকা উমরাতান) অর্থঃ হে আল্লাহ ! আমি ওমরার জন্য প্রস্তুত। নিয়তের সাথে সাথে নিম্মের দোয়া পড়ুনঃ
اللهم انى اريد العمرة قيسرها لي و تقبلها منى-
(“আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল উমরাতা ফাইয়াস্সিরহালি ওয়া তাকাব্বালহা মিন্নি”।)
অর্থঃ হে আল্লাহ, আমি উমরাহ পালন করার নিয়ত করছি। আপনি আমার এই উমরাকে আমার জন্য সহজ করে দিন এবং তা কবুল করে নিন। এরপর পুরা তালবিয়া পাঠ করুন। তালবিয়া যখনই পড়া হবে, কমপক্ষে তিনবার পড়া উচিত। তালবিয়া হলো নিম্নরূপঃ
لبيك-اللهم لبيك -لبيك لا شريك لك لبيك- إن الحمد- والنعمة- لك والملك- لا شريك لك.
)“লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক্, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক্, ইন্নাল্ হাম্দা, ওয়ান্-নি’মাতা, লাকা ওয়াল্ মুল্ক, লা শারীকা লাক।“(
অর্থ : (তোমার দরবারে ) আমি হাজির, হে আল্লাহ ! (তোমার দরবারে ) আমি হাজির - আমি হাজির, তোমার কোন শরীক নাই, (তোমার দরবারে ) আমি হাজির, নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই, আর সকল সাম্রাজ্রের মালিকও তুমি, তোমার কোন শরীক নাই।
মনে রাখতে হবে যে নিয়ত করা এবং তালবিয়া পাঠ করা ইহ্রামের ফরজ।
হানাফী মাজহাব অনুযায়ী ইহ্রাম বাঁধার সময় তালবিয়া পাঠ অথবা অন্য কোনো যিকর একবার পাঠ করা ফরজ এবং একাধিকবার সুন্নত। উমরার ক্ষেত্রে ইহ্রামের নিয়ত করার সময় থেকে তালবিয়ার এই দোয়া শুরু করতে হবে এবং অব্যহত থাকবে বায়তুল্লাহ শরীফে পৌছে তওয়াফ শুরুর আগ পর্যন্ত । তাই সবসময় তালবিয়া পাঠ করে যাওয়া উত্তম। বিশেষ করে গাড়ীতে উঠতে, গাড়ী থেকে নামতে, বিমানে উঠতে, বিমান থেকে নামতে, কোন উচু জায়গায় উঠতে ও নামতে, দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসার সময়, কারো কাছে বেড়াতে গেলে এবং প্রত্যেক নামাজের পরে পুরুষেরা সশব্দে তালবিয়া পাঠ করবেন। কিন্তু মহিলাদের জন্য উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়া নিষিদ্ধ। নিজের কানে শুনতে পান মহিলারা এমনভাবে আস্তে আস্তে পড়বেন। এটা অবশ্যই স্মরন রাখতে হবে যে বিমানে থাকা অবস্থায় সালাতের সময় হলে একাকীই সালাত আদায় করতে হবে। ওযু না থাকলে তায়াম্মুম করে নিতে হবে। কোন অবস্থাতেই সালাত কাযা করার অপেক্ষায় থাকা যাবে না।
এরপর বিমান থেকে নেমে হাজী সাহেবানরা তাদের পূর্বনির্ধারিত বাসস্থানে গিয়ে নিজের মাল-ছামান গুছিয়ে রেখে একটু বিশ্রাম নিয়ে ক্লান্তি দূর করে নিতে পারেন। তাছাড়া তাওয়াফের পূর্বে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হওয়া জরুরী। সম্ভব হলে গোছল করে নেয়া মুস্তাহাব। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এমনটি করতেন। তবে নাপাকী থেকে অবশ্যই পবিত্র হতে হবে। এভাবে পাক-পবিত্র হয়ে তালবিয়া পড়তে পড়তে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পবিত্র কাবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে।
পবিত্র কাবার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদুল হারামের উঁচু বিল্ডিং। এ বিল্ডিং এর যেকোন দরজা দিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করা যায়। তবে “বাবুস্ সালাম” দরজা দিয়ে ঢোকা উত্তম।
আপনি যখন মসজিদে হারামে প্রবেশ করবেন, তখন অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে মসজিদের দরজায় প্রথমে ডান পা রাখুন এবং আল্লাহ যেন আপনার জন্য তার রহমতের সকল দরজা খুলে দেন সে আকুতি নিয়ে মসজিদে প্রবেশের সময় নিচের দোয়াটি পড়ুন। দোয়াটি হল :
بسم الله-والصلاة والسلام علي رسول الله- اللهم اغفرلى ذنوبى -وافتح لى ابواب رحمتك.
)“বিসমিল্লাহি ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আ’লা রাসুলিল্লাহি ; আল্লাহুম্মাগফিরলি জুনুবিই, ওয়াফ্তাহলি আব্ওয়াবা রাহ্মাতিকা।“(
অর্থ : মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি ,দোয়া ও সালাম রাসুল (সাঃ) এর উপর । হে আল্লাহ আমার পাপসমুহ ক্ষমা কর, আর আমার জন্য তোমার রহমতের দরজা খুলে দাও।
মসজিদে হারামে প্রবেশ করে যখনই কাবা শরীফের উপর প্রথম দৃষ্টি পড়বে, তখনই তিনবার পড়ুন-‘আল্লাহু আকবর’। তারপর নিম্নের তাকবীরটি তিনবার পড়ুন , তাক্বিরটি হলো-:
الله اكبر - الله اكبر- لا اله الا الله - الله اكبر- الله اكبر- و لله الحمد -
(“আল্লাহু আক্বর, আল্লাহু আক্বর, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আক্বর, আল্লাহু আকবর, ওলিল্লাহিল্ হাম্দ।“)
অর্থ : আল্লাহ মহান , আল্লাহ মহান , আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নাই । আল্লাহ মহান , আল্লাহ মহান ,সমস্ত প্রশংসা তারই জন্য।
তারপর দুই হাত দোয়ার জন্য উঠান এবং দরুদ শরীফ পড়ে নিজের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে নিম্নের দোয়াটি করুন-
اللهم انى اسءلك رضاك - و الجنة - و اعوذ بك من سخطك و النار -
(“আল্লাহুম্মা ইন্নি আস্আলুকা রেদাকা ওয়াল জান্নাতা ও আউজুবিকা মিন্ সাখাতিকা ওয়ান্নার।“)
অর্থ : হে আল্লাহ ! আমি তোমার সন্তুষ্টি ও জান্নাত কামনা করি এবং তোমার রাগ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাই।
ইহা একটি দোয়া কবুলের বিশেষ সময়। দোয়া কবুলের এমন সুবর্ন সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়।
উমরার দ্বিতীয় কাজঃ তাওয়াফ করা (ফরজ)
কাবা শরীফের চারদিকে পাক-পবিত্র অবস্থায় শরীয়ত নির্দেশিত নিয়মে সাতবার ঘোরা বা চক্কর দেওয়াকে তাওয়াফ বলা হয়। তাই তাওয়াফের পূর্বে সবারই পাক-পবিত্র হওয়া জরুরী। কোন মহিলা হায়েয বা নিফাস অবস্থায় অথবা বিনা অজুতে তাওয়াফ করতে পারবেন না। পবিত্র হবার পর মহিলারা তাওয়াফ করবেন। এখন আপনি তাওয়াফ করার জন্য কাবাঘরের যে দিকে ‘হাজরে আসওয়াদ’ আছে সেদিকে চলুন এবং সম্ভব হলে ‘হাজরে আসওয়াদ’ এর কাছে পৌঁছে আপনি ইহ্রামের যে চাদর/কাপড় পরিধান করে আছেন, সেই চাদরের ডান অংশ ডান বগলের নিচে দিয়ে বাম কাঁধের উপর রেখে দিন। অর্থাৎ ডান কাঁধ খোলা থাকবে এবং বাম কাঁধ চাদরে ঢাকা থাকবে। এরূপ করাকে এজতেবা বলে।
কোন কোন পুস্তিকায় শুধুমাত্র প্রথম চক্করেই ইজতেবা করার কথা বলা হয়েছে। স্মরন রাখতে হবে যে, পূর্ণ তাওয়াফেই (সাত চক্করেই) ইজতেবা করতে হবে- অর্থাৎ চাদর/কাপড়কে এভাবেই রাখতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ শুধু উমরার তাওয়াফের জন্যই ইজতেবা করতে হয়। তাওয়াফের পর নামাজ ইজতেবা করা মাক্রুহ। তাই আগে বা পরে অন্য কোন সময় ইজতেবা করে রাখা যাবে না।
তৃতীয়তঃ ইজতেবা শুধু পুরুষের জন্য, মহিলারা ইজতেবা করবে না।
এখন ইজতেবা অবস্থায় আপনি কা’বা মুখ হয়ে এমনভাবে দাড়াবেন যেন ‘হাজরে আসওয়াদ’ আপনার ডানদিকে থাকে। পূর্বে ‘হাজরে আসওয়াদ’ বরাবর একটি খয়েরি রেখা ছিল। বর্তমানে তা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই ‘হাজরে আসওয়াদ’ সোজা মসজিদুল হারামের দেয়ালে থাকা সবুজ বাতি দেখে ‘হাজরে আসওয়াদ’ বরাবর এসেছেন কিনা তা নিশ্চিত করুন এবং এ পর্যন্ত যে তালবিয়া পড়ে এসেছেন তা বন্ধ করে দিন। তারপর এভাবে তাওয়াফের নিয়ত করুন :
اللهم انى اريد طواف بيتك الحرام سبعة اشواط- فيسره لى- و تقبله منى.
(আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদু তাও’য়াফা বাইতিকাল্ হারামে সাবআতি আশ্ওয়াতিন্ ফাইয়াস্সিরহুলি ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নি)
অর্থ : হে আল্লাহ ! নিশ্চয়ই আমি তোমার ঘর সাত বার তাওয়াফ করার ইচ্ছা পোষন করি । উহাকে আমার জন্য সহজ করে দাও এবং আমার পক্ষ থেকে ঐ কাজকে কবুল করে নাও।
তাওয়াফের নিয়ত করা ফরজ। তাই প্রথমে নিয়ত করে নিতে হবে। নিয়ত মুখে উচ্চারন না করে মনে মনে করলেও চলবে। তারপর ডানদিকে একটু চলুন যেন ‘হাজরে আসওয়াদ’ ঠিক আপনার সম্মুখ বরাবর হয়ে যায়। তারপর নামাজের তাক্বীর তাহ্রীমার মত দুই হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে বলুন-
بسم الله الله اكبر- لا اله الا الله- و لله الحمد- والصلاة و السلام علي رسول الله.
(বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর,লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওলিল্লাহিল্ হামদ্, ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলা’ রাসুলিল্লাহি)
অর্থ : মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি , তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নাই । সমস্ত প্রশংসা তারই জন্য। সালাত ও সালাম রাসুল (সাঃ) এর উপর।
এবং হাত নামিয়ে সম্ভব হলে (ভিড় না থাকলে) ‘হাজরে আসওয়াদের’ উপর হাত দু’টো এমনভাবে রাখুন যেমনভাবে সিজদার সময় রাখা হয়। এরপর আদবের সংগে ‘হাজরে আসওয়াদ’ চুম্বন করুন। চুম্বন করা দুষ্কর হলে, ডান হাত দিয়ে ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্পর্শ করুন এবং হাতের যে অংশ দিয়ে স্পর্শ করেছেন সে অংশে চুম্বন করুন।
কিন্তু বর্তমানে বাস্তব অবস্থা এমনই যে, ‘হাজরে আসওয়াদ’ চুম্বন বা স্পর্শ বা উভয়টাই অত্যন্ত কঠিন ও অনেকের পক্ষেই দুঃসাধ্য। মনে রাখতে হবে যে, ‘হাজরে আসওয়াদ’ কে চুম্বন করা মোস্তাহাব। তাই চুম্বন করার জন্য অন্য ভাইকে কষ্ট দেয়া বা নিজে স্বেচ্ছায় কষ্ট পাওয়া হারাম। তাই দুরে দাঁড়িয়ে ডান হাত উঁচু করে হাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করুন (যেহেতু এ ক্ষেত্রে হাত দিয়ে ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি, তাই হাতে চুম্বন করতেও হবে না। তবে কোন কোন পুস্তকে চুম্বনের কথা বলা হয়েছে) এবং কাবা শরীফকে আপনার বাম দিকে রেখে তাওয়াফ আরম্ভ করুন ও বায়তুল্লাহর দরজার দিকে চলুন। প্রথম তিন চক্করে পুরুষ হাজীরা রমল করবেন অর্থাৎ বীরের ন্যায় বুক ফুলিয়ে কাঁধ দুলিয়ে, ঘন ঘন কদম ফেলে, কিছুটা দ্রুত গতিতে চলুন। এটা সুন্নত। বাকী চার চক্করে চলার গতি স্বাভাবিক রাখুন। তওয়াফের সময় দৃষ্টি সংযত করে নীচের দিকে রাখুন এবং অত্যন্ত আদবের সাথে তাওয়াফ করুন। কিন্তু মহিলা হাজীরা কোন রমল করবেন না।
কিছু কিছু পুস্তিকায় প্রত্যেক তওয়াফে ভিন্ন ভিন্ন দোয়া পড়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে হাদীসে কিছু পাওয়া যায় না। যখন যে ধরনের আবেগ আসে, সে ধরনের দোয়া করুন। আল্লাহর প্রশংসা করুন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর দরুন পড়ুন। যে ভাষা আপনি ভাল বোঝেন ও আপনার মনের আকুতি সুন্দরভাবে প্রকাশ পায় সে ভাষাতেই দোয়া করুন। স্মরন রাখতে হবে যে এখানে দোয়া কবুলের সু-সংবাদ রয়েছে।
তারপর সামনে অগ্রসর হলে দেখতে পাবেন অর্ধবৃত্তাকারে মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর ঘেরা একটি স্থান। একে ‘হাতীম’ বলে তারপর আরো কিছুটা অগ্রসর হলে আপনি পৌছে যাবেন কাবা ঘরের পশ্চিম-দক্ষিন কোনে যাকে ‘রুক্নে ইয়ামানী’ বলে। যখন ‘রুক্নে ইয়ামানী’ কোনে পৌছাবেন, তখন সেই কোনে চুমু খাবেন না, কান পর্যন্ত হাত উঠাবেন না। সম্ভব হলে দুই হাতে কিংবা ডান হাতে শুধু স্পর্শ করতে পারেন। হাতে স্পর্শ করতে না পারলে দুর থেকে ইশারাও করবেন না।
‘রুক্নে ইয়ামানী’ থেকে ‘হাজরে আসওয়াদ’ পর্যন্ত যেতে যেতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিম্নের দোয়া পড়তেন-
ربنا اتنا فى الدنيا حسنة و فى الاخرة حسنة وقنا عذاب النار-
(রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনইয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাত, হাসানাতাও ওয়াকিনা আয়াবান্নার)।
অর্থ : হে আমাদের রব দুনিয়া ও আখেরাতে আমাদের মংগল প্রদান কর এবং জাহান্নামের আজাব থেকে বাচাও।
এই দোয়া পড়তে পড়তে ‘হাজরে আসওয়াদ’ বরাবর পৌছালে এক চক্কর পূর্ন হয়ে যাবে। এখন(বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার) বলে সম্ভব হলে পুনরায় ‘হাজরে আসওয়াদ’ এ চুমু খাবেন। অথবা হাতের দুই তালু দিয়ে ইশারা করে আবার পূর্বের নিয়মে তওয়াফ শুরু করুন। এমনিভাবে সাত চক্কর পুরা করে তাওয়াফ কার্য শেষ করে দিন এবং চাদরের ‘ইজতবা’ খুলে ডান কাঁধ ঢেকে দিন।
স্মরন রাখতে হবে যে তাওয়াফ করা অবস্থায় কা’বা শরীফের দিকে দৃষ্টি করবেন না এবং নিজের বুক ও পিঠ কাবা শরীফের দিক করবেন না। তবে ‘হাজরে আসওয়াদ’ -এ চুমু দেয়ার সময় বুক কাবা শরীফের দিকে করা যাবে।
তওয়াফের সাত চক্কর, পূর্ন করে সম্ভব হলে ‘মুলতাযামে’ আসুন। ‘হাজরে আসওয়াদ’ এবং কা’বা ঘরের দরজার মধ্যবর্তী স্থানকে ‘মুলতাযাম’ বলে। ‘মুলতাযাম’ ধরে খুব দোয়া করুন। কিন্তু যদি এখানে খোশবু লাগানো থাকে, (যেমন- সবসময় লেগে থাকে) অথবা যদি এখন এখানে প্রচন্ড ভিড় থাকে, তবে এখন নয়। অন্য এক সময়ে সুযোগ-সুবিধা মত ‘মুলতাযাম’ কে আঁকড়ে প্রানভরে দোয়া করে নেবেন। এটা দোয়া কবুলের খাস জায়গা।
তাওয়াফ শেষ করার পর ‘মাকামে ইব্রাহীম’ কে সামনে নিয়ে অর্থাৎ ‘মাকামে ইব্রাহীম’এর পিছনে দুই রাকাত ‘সালাতুত তাওয়াফ’ এর নিয়তে দুই কাঁধ ঢেকে আদায় করুন। ভিড়ের কারনে এখানে সম্ভব না হলে তবে এর আশে পাশে কোথাও পড়ে নিন। তাও না পারলে ‘মসজিদুল হারাম’ এর যে কোন স্থানে এই নামাজ আদায় করে দোয়া করে নিন। প্রথম রাকাতে সুরা ফাতেহার পরে সুরা কাফেরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ফাতেহার পর সুরা এখলাস দ্বারা এই নামাজ আদায় করা উত্তম। নবীজি এভাবে পড়তেন। হানাফী মাজহাবে এই নামাজ ওয়াজিব।
মনে রাখতে হবে যে, ‘মাকামে ইব্রাহীম’ দোয়া কবুলের অন্যতম বিশেষ স্থান।
তাওয়াফের ওয়াজিব নামাজ পড়ার পর ‘যমযম’ কুপের কাছে আসুন এবং যমযমের এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে কেবলামুখী হয়ে দাড়িয়ে নীচের দোয়াটি পড়ুন-
اللهم انى اسئلك علما نافعا- و رزقا واسعا- و شفاء من كل داء.
(আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিয়ান - ওয়া রিজকান ওয়াসিয়ান - ওয়া শিফায়ান মিন কুল্লি দায়ীন।)
অর্থ : হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে ফলপ্রসু ইলম, স্বচ্ছল রিজিক এবং সকল রোগের নিরাময় কামনা করছি।
এবং তিন শ্বাসে ‘আবে যমযমের’ পানি পান করুন। যমযমের পানি তৃপ্তি সহকারে পেট ভরে পান করুন এবং কিছুটা পানি নিজের মুখমন্ডলে ও বুকে ছিটিয়ে দিন। তারপর কেবলামুখী হয়ে দোয়া করুন। এখানেও দোয়া কবুলের সু-সংবাদ রয়েছে।
যার শরীর পবিত্র আছে তিনি বরকতের জন্য যমযমের পানি দ্বারা ওজু অথবা গোসল করতে পারেন। এভাবে যমযমের পানি দ্বারা ওজু করা জায়েজ। তবে যমযমের পানি দ্বারা এস্তেঞ্জা এবং কাপড়ের নাপাকী দুর করার জন্য ব্যবহার করা অনুচিত।